আরাকানের মজলুম রোহিঙ্গাদের বিপ্লবী নেতা কাশেম রাজার ছেলে কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগ সহ-সভাপতি শাহ আলম চৌধুরী ওরফে রাজা শাহ আলমকে উখিয়া উপজেলা সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক করায় উল্লাস করছে রোহিঙ্গারা। শাহ আলমকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অধিষ্ঠিত করতে আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়ায় আরজ জানিয়েছেন কুতুপালং ক্যাম্পের শরণার্থীরা। ক্যাম্পের মসজিদে মসজিদে আয়োজিত খতমে কোরআন শেষে দোয়া মাহফিলে এ আরজ জানানো হয়। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং স্থানীয়রা।
এমন একটি ভিডিও সোমবার (১৪ সেপ্টেম্বর) রাতে প্রচার পাওয়ার পর কক্সবাজারজুড়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। অনেকে বলছেন, মানবিক আশ্রয় পাওয়া রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি নাগরিকত্ব বাগিয়ে নেয়া রোহিঙ্গাদের সামনে রেখে এদেশে স্থায়ী হতে যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন তারই বহিঃপ্রকাশ এ দোয়ার উচ্চারণ।
স্থানীয়রা বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবিক কারণে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় না দিলে বহু রোহিঙ্গার প্রাণহানি ঘটে যেত রাখাইনে। রোহিঙ্গারা উদ্বাস্তু। আশ্রিত হিসেবে থাকবে। তারা দলীয় বিষয় নিয়ে নাক গলাবে কেন? বিষয়টি নজরে এলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের উখিয়ার ওই সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি বন্ধ রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন। জানা যায়, উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা একযোগে দলীয় কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কোন ধরণের কোন্দল নেই। শেখ হাসিনার হাতকে আরও শক্তিশালী করতে উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে জনসেবামূলক বিভিন্ন কর্মকান্ড চালাচ্ছে নেতাকর্মীরা। এ অবস্থায় জেলা আওয়ামী লীগ গঠনতন্ত্র বহির্ভূত সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি গঠন করলে বিষয়টি দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদকের নজরে আনা হয়। সেতুমন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতিকে উখিয়ার ওই সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। দলীয় হাই কমান্ডের নির্দেশনা থাকা সত্বেও সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক শাহ আলম ওরফে রাজা’র পক্ষে শিবিরে মসজিদে মোনাজাত ও রোহিঙ্গারা উল্লাস করায় স্থানীয় জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
সচেতন মহল জানান, উখিয়া টেকনাফ ছিল বিএনপি-জামায়াত অধ্যুষিত এলাকা। বঙ্গমাতা মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী তৃণমুল নেতাকর্মী থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সুসংগঠিত করায় উখিয়া টেকনাফ আসনে বিএনপি প্রার্থীকে পরাজিত করে বারবার আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী জয়ী হয়ে আসছেন। অসাধু ও অনুপ্রবেশকারী কিছু নেতা উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের পদকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ধান্ধা করার উদ্দেশে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করছে বলে জানিয়েছেন দলীয় নেতাকর্মীরা।
আওয়ামী লীগ কর্মীরা বলেন, আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন থাকায় গ্রাম-গঞ্জের মানুষ শান্তিতে বসবাস করছে। উখিয়া টেকনাফ যেহেতু রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা, সে হিসেবে রোহিঙ্গার স্বজন বা মিয়ানমারের বাসিন্দা সংশ্লিষ্ট কাউকে আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক করাটা উচিত হবেনা। এটি দলের জন্য বদনাম টেনে আনবে। রোহিঙ্গাদের একসময়ের ‘বিপ্লবী নেতা’ মৃত আবুল কাশেম ওরফে কাশিম রাজার ছেলে শাহ আলমকে আহ্বায়ক করে উখিয়া উপজেলা সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি ঘোষণা করেন জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মেয়র মুজিবুর রহমান। এতে রোহিঙ্গারা উল্লাসে ফেটে পড়ে। শাহ আলমের পক্ষে ক্যাম্পে বিভিন্ন মসজিদে দোয়া মাহফিল হয়। মোনাজাতে রোহিঙ্গা মৌলবি আমাদের বার্মার (মিয়ানমার) বাসিন্দা কাছিম রাজার পুত্র শাহ আলম ওরফে রাজা শাহ আলম উখিয়ার বড় নেতা বনেছেন বলে উল্লেখ করে তার জন্য মোনাজাত করার একাধিক ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহবায়ক হওয়ার সেই খুশিতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চলছে শুকরিয়া মোনাজাত। রাজা শাহ আলম বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন- এমন স্বপ্নও দেখছেন রোহিঙ্গারা। এই ঘটনায় কক্সবাজার জুড়ে তুমুল সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ২ মিনিট ৩৩ সেকেন্ডের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, প্রথমে কাশেম রাজার ছেলে কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগ নেতা রাজা শাহ আলম উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক হওয়ায় শোকরিয়া জানানো হয়। পরে তাকে আরও বড় পদে নেয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে দিতে আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়ায় আরজ জানিয়েছেন কুতুপালং শরণার্থীরা ক্যাম্পের মাওলানারা।
১৯৫৬ সালে মিয়ানমার সরকারের চাপের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন আবুল কাশেম ওরফে কাসেম রাজা। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে উখিয়ার ইনানীর পাহাড়ি এলাকায় স্বপরিবারে আশ্রয় নেন কাছিম রাজা। কাছিম রাজার ৩ ছেলে ও ২ মেয়ের মধে প্রথম ছেলে হলেন শাহা আলম চৌধুরী ওরফে রাজা শাহ আলম। পাকিস্তান সরকার এই কাশেম রাজাকে ব্যবহার করে আরাকান রাজ্যের তথা পাকিস্তান-বার্মা সীমান্ত পরিস্থিতি শান্ত রাখতেন বলে জানা গেছে। মিয়ানমারের গুপ্তচররা ১৯৬৬ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর উখিয়ার ইনানী পাহাড়ী এলাকায় কাছিম রাজাকে হত্যা করে। রাজা শাহ আলম কক্সবাজারে বিভিন্ন ব্যবসার সূত্রে ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগ নেতাদের সংস্পর্শে চলে আসেন।
সূত্রমতে, কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক অর্থ সম্পাদক ও বর্তমান কমিটির সহ-সভাপতি হোটেল ব্যবসায়ী শাহ আলম চৌধুরী ওরফে রাজা শাহ আলম সম্প্রতি উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক মনোনীত হয়েছেন। ইতোমধ্যে ৩৩ সদস্যের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি গঠন করেছেন তিনি। রাজা শাহা আলম রোহিঙ্গাদের বিপ্লবী নেতা কাশেম রাজার সন্তান। ৬০এর দশকে মিয়ানমার সরকারের চাপের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন কাশেম রাজা। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে কক্সবাজারের উখিয়ার ইনানীর পাহাড়ি এলাকায় স্বপরিবারে আশ্রয় নেন তিনি। পরিবর্তীতে সেই এলাকাতেই বসতি স্থাপন করে ধীরে ধীরে সেখানে থিতু হন নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের বিপ্লবি এই নেতা। সেখানে জন্ম হয় কাশেম রাজার ৩ ছেলে ও ২ মেয়ের। আর কাশেম রাজার প্রথম সন্তান হলেন শাহা আলম চৌধুরী ওরফে রাজা শাহ আলম।
সূত্র আরো জানায়, ৭০’র দশকে মিয়ানমারের গুপ্তচরেরা উখিয়ার ইনানীর পাহাড়ি এলাকায় কাশেম রাজাকে হত্যা করে। এরপর পরিবারের হাল ধরেন রোহিঙ্গা নেতার বড় ছেলে রাজা শাহ আলম। তবে তিনি রোহিঙ্গাদের জন্য বাবার মতো সক্রিয় লড়াই করার পরিবর্তে পরিবার গোছানোর কাজে মনোনিবেশ করেন। শুরু করেন মাছের ব্যবসা। ধীরে ধীরে ব্যবসায় সফলতার হাত ধরে কক্সবাজার সৈকতের লাবণী পয়েন্টে হোটেল মিডিয়া নামের একটি পর্যটন সেবী আবাসন প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেন তিনি। এভাবে ক্রমে বিত্ত বৈভবের মালিক হলেও পিতার আদর্শ ভুলে যাননি তিনি। নিত্য খবরাখবর রাখেন জাতিগত নিপীড়নের শিকার রোহিঙ্গাদের। জনশ্রুতি আছে যেকোনো সমস্যায় তার কাছে গেলে তিনি বিমুখ করেন না। বিপন্নরা রোহিঙ্গা হলে খাতির পান একটু বেশি। তাই কাশেম রাজা সম্পর্কে অবগত রোহিঙ্গারা রাজা শাহ আলমকে নিজেদের ‘আশ্রয়স্থল’ বলে মনে করেন।
স্থানীয় সূত্র মতে, পর্যটন ব্যবসায় সম্পৃক্ততার সূত্রে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক নেতাদের সংস্পর্শে চলে আসেন রাজা শাহ আলম। যে সরকারই ক্ষমতায় এসেছে সে দলের ক্ষমতাধরদের আস্থাভাজন হিসেবে থেকেছেন। তবে কোনো দলে তার এককভাবে সম্পৃক্ততার কথা শোনা যেত না। কিন্তু ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাজা শাহ আলম কক্সবাজার সার্কিট হাউস এলাকায় সড়কে লাগোয়া একটি বহুতল ভবন গড়েন। সেই ভবনেই উখিয়া-টেকনাফের সাবেক বিতর্কিত সংসদ সদস্য এবং রোহিঙ্গাদের কাছেরজন হিসেবে পরিচিত আব্দুর রহমান বদি ও তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সালাউদ্দিন আহমেদ সিআইপিকে নামমাত্র মূল্যে একেকটি ফ্ল্যাট উপহার দেন। তখন থেকেই আওয়ামী রাজনীতিতে নাম যুক্ত হয় রাজা শাহ আলমের। সেবার জেলা কমিটিতে অর্থ সম্পাদকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ পান তিনি। বাড়তে থাকে তার প্রতিপত্তি। বাবার সুবাদে তার বড় ছেলেও জেলা যুবলীগের প্রস্তাবিত কমিটির অর্থ সম্পাদক হিসেবে যুক্ত হন।
এদিকে নানাভাবে জেলা নেতৃবৃন্দের সুনজরে থাকায় গত ৯ সেপ্টেম্বর ঘোষিত উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব পান শাহা আলম চৌধুরী ওরফে রাজা শাহ আলম। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আদিল উদ্দিন চৌধুরীসহ ত্যাগী অনেক নেতাকে নিয়ে ৩৩ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটিও ঘোষণা হয়েছে সম্প্রতি। এ নিয়ে উখিয়ায় সরকারদলীয় রাজনীতি সরগরম হয়ে উঠেছে। এ খবর চাউর হয়েছে বিশাল রোহিঙ্গা শিবিরেও।
স্থানীয় সূত্র মতে, এই ঘটনায় উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পজুড়ে শুকরিয়া মোনাজাত হলেও চরম অসন্তোষ চলছে উপজেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। এমনকি রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকার বাসিন্দারাও রোহিঙ্গা জঙ্গীদের মোনাজাতের ভাষা শুনে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক রোহিঙ্গা বলেন, মিয়ানমার সরকার কর্তৃক আমাদের উপর চালানো জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে কাশেম রাজা প্রতিবাদ করতেন বলে জেনেছি। তারই সন্তান রাজা শাহ আলম। আমাদের কওম হিসেবে রোহিঙ্গাদের দুঃখ তিনিও বোঝেন বলে আমাদের বিশ্বাস। আমাদেরই একজন বাংলাদেশের চলমান সরকারি দলের বড় পদে এসেছে এটা আমাদের জন্য শোকরিয়ার। তাই আমরা মসজিদে খতমে কোরআন ও দোয়ার মাহফিল করেছি।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট সিরাজুল মোস্তফা বলেন, নিয়মমতে পরিচ্ছন্ন যে কেউ দলে সম্পৃক্ত হতে পারেন। শাহ আলম চৌধুরীও আমাদের মাঝে তেমনই একজন। কেউ কারো জন্য শুভকামনা বা কোনো বড় কিছু প্রত্যাশা করে দোয়া করলে সেটার দায় দোয়াকারীদের উপর বর্তায়। তবে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের কামনা একটু বেশি হয়ে গেছে বলে মনে হলো।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক শাহা আলম চৌধুরী ওরফে রাজা শাহ আলমের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও ফোন রিসিভ না করায় তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।