চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় ৩৪ বছর একচ্ছত্র কর্তৃত্ব ছিলো হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফীর। বৃহস্পতিবার (১৭ সেপ্টেম্বর) ছাত্রদের বিক্ষোভের মুখে তিনি হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালকের পদ থেকে সরে দাঁড়ান। শুক্রবার (১৮ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় ইন্তেকাল করেন তিনি। শতবর্ষী এই মানুষটির চলে যাওয়া অনেকটা স্বাভাবিক হলেও শেষ মুহূর্তে তার মনে কষ্ট ছিল বলে জানিয়েছেন স্বজনরা।
সারাদেশের আলেম-উলামার কাছে অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে বিবেচিত শাহ আহমদ শফীর জন্ম চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পাখিয়ারটিলা গ্রামে। তার বাবার নাম বরকম আলী, মা মোছাম্মাৎ মেহেরুন্নেছা বেগম। আহমদ শফী দুই ছেলে ও তিন মেয়ের জনক।
তার দুই ছেলের মধ্যে আনাস মাদানী হেফাজতে ইসলামের প্রচার সম্পাদক। তিনি হাটহাজারী মাদ্রাসার সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে কর্মরত থাকলেও সম্প্রতি এক ছাত্র বিক্ষোভের মুখে সে পদ থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়। অন্যজন মাওলানা মোহাম্মদ ইউসুফ পাখিয়ারটিলা কওমি মাদ্রাসার পরিচালক।
শফীর শিক্ষাজীবন শুরু হয় রাঙ্গুনিয়ার সরফভাটা মাদ্রাসায়। এরপর পটিয়ায়র আল জামিয়াতুল আরাবিয়া মাদ্রাসায় (জিরি মাদ্রাসা) লেখাপড়া করেন। ১৯৪০ সালে তিনি হাটহাজারীর দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসায় ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে তিনি ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসায় যান, সেখানে চার বছর লেখাপড়া করেন। ১৯৮৬ সালে হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক পদে যোগ দেন আহমদ শফী।
চট্টগ্রামের হাটহাজারীর ‘বড় মাদ্রাসা’ নামে পরিচিত আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসা দেওবন্দের পাঠ্যসূচিতে পরিচালিত বাংলাদেশের অন্যতম বড় এবং পুরনো কওমি মাদ্রাসা। সাত হাজারের বেশি শিক্ষার্থী সেখানে অধ্যয়ন করে।
দেশের আলেমদের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র আহমদ শফী বাংলায় ১৩টি এবং উদুর্তে নয়টি বইয়ের রচয়িতা। মূলত ২০১৩ সালে গণজাগরণ আন্দোলন শুরুর পর তার বিরোধিতায় হেফাজতে ইসলামকে নিয়ে মাঠে নেমে আলোচনায় উঠে আসেন আহমদ শফী।
জীবদ্দশায় হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালকের পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশেরও (বেফাক) সভাপতি পদে ছিলেন। এছাড়া কওমি মাদ্রাসাগুলোর সমন্বিত বোর্ড আল হাইয়াতুল উলয়ার তিনি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছিলেন। তার নেতৃত্বেই ২০১৭ সালে সরকার কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্স সমমান দেয়।
কওমি অঙনের মূল সংগঠন হেফাজতে ইসলামির শিরোমনি ছিলেন আল্লামা শাহ আহমদ শফী। তিনি যাই বলতেন তাই শেষ কথা ছিলো একসময়। সম্মানের এমন আসনে আসীন ছিলেন তিনি। কিন্তু হঠাৎ মাত্র দু‘দিনের ছাত্র বিক্ষোভে পতন হলো আল্লামা শফীর।
ছাত্র বিক্ষোভের এক পর্যায়ে বৃহস্পতিবার তিনি অসুস্থতার কারণে হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক পদ থেক নিজেই অব্যাহতি নেন। তবে তাকে আমৃত্যু সদরুল মুহতামিম বা উপদেষ্টা হিসেবে রাখার সিদ্ধান্ত হয়।
আহমদ শফীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সম্প্রতি যখন তাকে মাদ্রাসার মহাপরিচালকের পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর দাবি উঠছিলো বিভিন্ন মহল থেকে তখন তিনি আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘আমি এই প্রতিষ্ঠানের জন্য কী না করেছি! আজ আমাকেই সরিয়ে দেয়ার পাঁয়তারা হচ্ছে।’
তবে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা জানান, বয়সের কারণে দায়িত্ব পালনে অপারগ হয়ে যাওয়ায় তারা শফীকে বাদ দেয়ার দাবি তুলেছিলেন। তবে তাকে মাদ্রাসা থেকে একদম বাদ দেয়ার পক্ষে ছিলেন না তারা। মাদ্রাসার প্রধান মুরব্বি হিসেবে আহমদ শফীকেই রাখার পক্ষে ছিলেন তারা। মূলত তার ছেলে আনাস মাদানীর বিরুদ্ধেই ছিল ছাত্রদের প্রধান ক্ষোভ।
এদিকে হেফাজত মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীর সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে আহমদ শফীর। অনেকের মতে, শফী ও জুনাইদ বাবুনগরীর বিরোধ দীর্ঘদিনের। সেই শাপলা চত্বর থেকে শুরু এই বিরোধের। বিরোধ নিয়ে দু’পক্ষের বিবৃতি প্রায়ই গণমাধ্যমে আসতো। এরমধ্যেও জুনাইদ বাবুনগরী সতর্ক অবস্থানে ছিলেন সবসময়। যদি বিবৃতির কোন অংশে কষ্ঠ পান মুরুব্বী শফী! তাই তিনি বিরোধকে বিরোধও বলতেন না, বলতেন নিজেদের মধ্যে অসন্তোষ।
অন্যদিকে শফীও যে একেবারে অসতর্ক ছিলেন তা নয়। কওমি অঙনের ক্ষতি হয় এমন কোন বক্তব্য তিনিও দিতেন না। হঠাৎ বেফাস কিছু যদি বলে ফেলে, এই চিন্তা থেকে গণমাধ্যমেও তেমন কোন কথা বলতেন না দু‘জনই। গণমাধ্যমকর্মী থেকে দূরে রাখতে নিজেরা কোন মুঠোফোনও ব্যবহার করতেন না। গণমাধ্যমের ফোন যেত তাদের প্রেস সচিবের কাছে। বিষয় জেনে-শুনে স্থির হওয়ার পর গণমাধ্যকর্মীর ভাগ্যে জুটত কথা বলা।
হাটহাজারী মাদ্রাসার একজন সিনিয়র শিক্ষক বলেছেন, আহমদ শফীর বয়স একশর বেশি হয়েছে। বয়সের ভারে তিনি এক দশকের বেশি সময় ধরে কোন কর্মকাণ্ড চালাতে পারছেন না। ফলে তার উত্তরসূরি কে হবেন- এই প্রশ্নে অনেকদিন ধরেই মাদ্রাসার শিক্ষকদের মধ্যে নানা আলোচনা ছিলো।
তিনি জানিয়েছেন, মাদ্রাসার সিনিয়র শিক্ষক জুনায়েদ বাবুনগরীকে ২০১৭ সালে সহকারী পরিচালক করা হয়েছিলো। তিনিই উত্তরসূরি হতে পারেন-এমন একটা আলোচনা ছিলো। কারণ তাকে হেফাজতে ইসলামের মহাসচিবও করা হয়েছিল।
কিন্তু ঐ সিনিয়র শিক্ষক মনে করেন, আনাস মাদানীর পরামর্শে শফী মাদ্রাসার সাবেক একজন শিক্ষক শেখ আহমদকে আবার ফিরিয়ে আনেন। তখন এটা স্পষ্ট হয় যে বাবুনগরীকে ঠেকানোর জন্য তাকে আনা হয়েছে। এনিয়ে বাবুনগরী এবং তার সমর্থকদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হচ্ছিল।
সর্বশেষ গত ৯ জুলাই দু‘পক্ষের বিরোধ মিটিয়ে সমঝোতার বিবৃতি দিয়েছিলেন শফী ও জুনাইদ বাবুনগরী। কিন্তু দু‘মাসের মাথায় গত বুধবার দুপুরে হঠাৎ শুরু হয় মাদ্রাসায় ছাত্রদের বিক্ষোভ। মাদ্রাসার ফটকগুলোতে তালা লাগিয়ে বিক্ষোভ করেন ছাত্ররা। যাতে বহিরাগত বা প্রশাসনের কেউ সেখানে প্রবেশ করতে না পারে। খবর পেয়ে পুলিশ, র্যাব উপস্থিত হলেও মাদ্রাসার মসজিদের মাইক থেকে বার বার ঘোষণা দেয়া হয় যাতে তারা সেখানে প্রবেশ না করে।
বলা হচ্ছিল-এই ছাত্র বিক্ষোভ মাদ্রাসার অভ্যন্তরীণ বিষয়। যা মাদ্রাসার শুরা মজলিস ছাড়া সমাধানের কোন এখতিয়ার প্রশাসনের নেই। প্রশাসন যদি জোর করে প্রবেশ করে কোন রকম হস্তক্ষেপ করে তার দায় প্রশাসনকে নিতে হবে।
রাত ১১ টার পর ছাত্র বিক্ষোভ থামে। কারণ এর আগে মাদ্রাসার শুরা মজলিসের তিন সদস্য বৈঠকে মাদ্রাসা থেকে শফিপূত্র আনাস মাদানীকে বহিষ্কারের দাবি মেনে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ছাত্রদের ৬ দফা দাবির অন্যতম ছিল এটি।
এরপরের দাবি, মাদ্রসার মহাপরিচালক থেকে আল্লামা শফির সম্মানজনক অব্যাহতি, এছাড়া মাদ্রাসা থেকে আনাস মাদানী কর্তৃক চাকুরিচ্যুত শিক্ষক-কর্মচারীদের বহাল, আনাস মাদানী কর্তৃক শিক্ষক-কর্মচারীদের নিয়োগ বাতিল, শিক্ষার্থীদের উপর সবধরণের জুলুম ও হয়রানি বন্ধ, মাদ্রাসার শুরা মজলিস থেকে আওয়ামী লীগের দালাল উলামাদের বাদ দিয়ে যোগ্যদের অর্ন্তভুক্ত করা।
কিন্তু বৃহস্পতিবার ভোরে উঠে দুই মাসের জন্য মাদ্রাসা বন্ধের খবরে ফের বিক্ষোভে নামেন মাদ্রাসার ছাত্ররা। সকাল ১১টার দিকে তারা আল্লামা শফিকে অবরুদ্ধ ও আনাস মাদানীসহ অনুসারী শিক্ষকদের কক্ষ ভাংচুর করে। এ সময়ও পুলিশ, র্যাবের একটি দল মাদ্রাসার বাইরে অবস্থান নেয়। এরপর বিকেলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাটহাজারী মাদ্রাসা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। যা প্রত্যাখ্যান করে আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে ছাত্ররা। একপর্যায়ে রাতে আহমদ শফী নিজেই মহাপরিচালকের পদ থেকে সরে দাড়ানোর ঘোষণা দেন।
বিশ্লেষকদের মতে, এই ছাত্র আন্দোলন দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভুত ক্ষোভের ফসল। যার শুরু ৫ মে শাপলা চত্বর থেকে। সেদিন লাখো কওমি জনতা ও জুনাইদ বাবুনগরীকে পুলিশের কব্জায় ফেলে চট্টগ্রামে চলে আসেন আহমদ শফী ও তার ছেলে আনাস মাদানী। সেই থেকে চরম অসন্তোষ দানা বাঁধে কওমি আলেম-উলামাদের মাঝে। এতে মূলত দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে আলেম-উলামারা। সেই থেকে আহমদ শফী ও জুনাইদ বাবুনগরীর বিরোধ বাড়তে থাকে।
মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, আনাস মাদানী শুধু নিজের স্বার্থে পিতাকে অন্যায় পথে পরিচালনা করেননি, ক্ষমতা কুক্ষিগত করে প্রভাব বিস্তারও করেছেন হাটহাজারী মাদ্রাসায়। কওমি মাদ্রাসা বোর্ড বেফাক ও হেফাজতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছেন। করেছেন সিনিয়র নেতাদের অবমূল্যায়ন। করেছেন মাদ্রাসার শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকুরিচ্যুত, নিয়োগ বাণিজ্য। গড়েছেন অঢেল সম্পদ। সরকারের দালাল হিসেবেও চিহ্নিত হন তিনি। যার ফসল এই ছাত্র আন্দোলন।
জানা যায়, ছাত্র আন্দোলন শুরুর আগে গত শুক্রবার চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার বাবুনগর মাদ্রাসায় আল্লামা শফি বিরোধী কওমি উলামারা বৈঠক করেন। এতে চট্টগ্রামসহ দেশের শীর্ষ কওমি উলামারা উপস্থিত ছিলেন। যেখান থেকে সূচনা এই ছাত্র আন্দোলনের। এ বিষয়ে কথা বলতে বার বার ফোন করা হলেও কেটে দেন আনাস মাদানী।
বার্ধক্যজনিত কারণে অনেক দিন ধরে শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন আহমদ শফী। গত কয়েক বছরে তাকে বেশ কিছু দিন হাসপাতালে কাটাতে হয়েছে। মাঝে ভারতেও চিকিৎসা নিয়ে আসেন তিনি। গত ১১ এপ্রিল হজম এবং অন্যান্য শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়ায় নগরীর বেসরকারি সিএসসিআর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল আহমদ শফীকে। পরে শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে তিন দিন পর তাকে হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে গেন্ডারিয়ার আজগর আলী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিলো। সুস্থ হয়ে গত ২৬ এপ্রিল তিনি চট্টগ্রামে ফেরেন। আবার অসুস্থ হলে সেই হাসপাতালে আনার পরই না ফেরার দেশে চলে গেলেন আল্লামা শফী।