তথ্যমতে, প্রতি ২০ সেকেন্ডে একটি করে সাইবার অপরাধ ঘটছে। পুলিশসহ সরকারি সংশ্লিষ্ট সেলে প্রতিদিন জমা পড়ছে শত শত অভিযোগ। ভুক্তভোগীদের বেশিরভাগই নারী। এর পরেই রয়েছে তরুণ ও যুবকদের সংখ্যা।
সাধারণত ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, গুগল, স্কাইপ- এ ভুয়া আইডি খুলে বিভিন্ন অনলাইন পোর্টাল ও ব্লগে মিথ্যা ও মানহানিকর তথ্য প্রচার, অশ্লীল ছবি ও ভিডিও আপলোড এবং মিসেজ পাঠিয়ে প্রতারণার ঘটনাগুলোই মোটা দাগে সাইবার অপরাধ হিসেবে পরিচিত।
সাইবার ক্রাইমের মধ্যে পারিবারিক বিদ্বেষ সৃষ্টি, স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া, বন্ধু-বান্ধবের মধ্যে বিরোধ তৈরি, উগ্র ও বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্য প্রচার, ইউটিউবে অন্তরঙ্গ ভিডিও ও ছবি আপলোড, ফেক অ্যাকাউন্ট তৈরি, পাসওয়ার্ড বা গোপন নম্বর অনুমান করে আইডি হ্যাক, মোবাইল ব্যাংকিং, ই-কমার্স ও ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি, অনলাইন এমএলএম (মাল্টি লেভেল মার্কেটিং), অনলাইনে প্রশ্নপত্র ফাঁস ও অনলাইন গ্যাম্বলিং (জুয়া) বেশি হয়ে থাকে।
নানা প্রলোভনে মুহূর্তেই বড় ধরনের প্রতারণার ফাঁদে ফেলে সাধারণত মানুষকে সর্বস্বান্ত করা হচ্ছে। বিশেষ করে অনলাইনে আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। অনলাইনে ডলার বেচা-কেনা, ভর্তি পরীক্ষার ফরম পূরণ, কেনাকাটা, এমনকি অনলাইন ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রেও অসংখ্য অপরাধের ঘটনা ঘটছে।
ই–কমার্স বা অনলাইনে কেনাকাটায় প্রতারণার অভিযোগও রয়েছে বিস্তর। অনেকে অনলাইনে একটি পণ্য অর্ডার করে পাচ্ছেন অন্যটি। আবার কখনো কখনো দেখানো পণ্যের সঙ্গে সরবরাহ করা পণ্যের মিল পাওয়া যায় না। মাত্র এক হাজার ২০০ ই–কমার্স প্রতিষ্ঠান নিবন্ধিত হলেও অনলাইনে ব্যবসা করছে অনিবন্ধতিত প্রায় ৭০-৮০ হাজার প্রতিষ্ঠান।
ইদানিং করোনা সুরক্ষাসামগ্রী বিক্রি কিংবা অনলাইনে নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট দেয়াকে কেন্দ্র করেও প্রতারণার ঘটনা ঘটছে। ফলে অর্থনৈতিক ক্ষতি হওয়া ছাড়াও স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে মানুষ।
পুলিশের ক্রাইম ডেটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের (সিডিএমএস) পরিসংখ্যান বলছে, সাইবার অপরাধ সংক্রান্ত মামলার সংখ্যাও বাড়ছে। ২০১৩ সালে ৩৫টি ও ২০১৪ সালে ৬৫টি মামলা হয় সারাদেশে। ২০১৪ থেকে ২০১৫ সালে মামলা হয় ৫৯৭টি, যার মধ্যে ১৩৭টি ঢাকায়। ২০১৬ সালে মামলা হয় ৮৭৯টি, যার মধ্যে ঢাকায় ২০৬টি। ২০১৭ সালে মামলা হয় এক হাজার ২৮টি, যার মধ্যে ঢাকায় ২৩৬টি। ২০১৮ সালে মামলা হয় এক হাজার ৫৫টি, যার মধ্যে ৩৩৩টি ঢাকায়। তথ্য বলছে, ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালে শুধু ঢাকায়ই মামলা হয়েছে ৯১২টি।
অপরাধের শিকার হওয়া নাগরিকদের মধ্যে ৩৪ শতাংশের বয়স ১৯ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। ৩১ শতাংশের বয়স ২৬ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। ২৭ শতাংশের বয়স ৩৬ থেকে ৫৫ বছরের মধ্যে। ৬ শতাংশের ১৮ বছরের মধ্যে। আর দুই শতাংশের বয়স ৫৫ বছরের বেশি। পরিসংখ্যান বলছে, ক্ষতিগ্রস্তদের ৫৩ শতাংশ নারী, পুরুষ ৪৭ শতাংশ। ২৩ থেকে ২৫ বছর বয়সী নারীরাই সবচেয়ে বেশি সাইবার অপরাধের শিকার হন।
শুধু ঢাকা মহানগর পুলিশের কাছেই সাইবার অপরাধ নিয়ে বছরে অভিযোগ জমা পড়ে ২০ হাজারও বেশি। এর মধ্যে মহানগর পুলিশের ‘হ্যালো সিটি’ অ্যাপসের মাধ্যমেই অভিযোগ জমা পড়ে ছয় হাজারেরও বেশি। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের সাইবার হেল্প ডেস্কেও বছরে ১০ হাজারের বেশি অভিযোগ জমা পড়ছে।
বাংলাদেশ সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের গত বছরের গবেষণার তথ্যে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে যত সাইবার অপরাধ হয়, তার প্রায় ৭০ শতাংশের শিকার হচ্ছে কিশোরীরা। প্রযুক্তি ব্যবহারকারীরা ১১ ধাপে সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছে। এর মধ্যে চারটিই নতুন। ইন্টারনেট ব্যবহার করতে গিয়ে সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছে ৬৭.৯ শতাংশ নারী। এর মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচারের শিকারে সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে তারা। এই অপরাধের শিকার নারীর হার ১৬.৩ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে অনলাইনে বার্তা পাঠিয়ে হুমকি। ছবি বিকৃত করে অনলাইনে অপপ্রচারের শিকার হওয়া নারীর হার ১১.২ শতাংশ।
জরিপে বলা হচ্ছে, পর্নোগ্রাফিকেন্দ্রিক অপরাধ ২.২৫ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬.০৫ শতাংশে। অনলাইনে বার্তা পাঠিয়ে হুমকির ঘটনা ১৩.৫ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৭.৬৭ শতাংশে।
বিটিআরসির তথ্য অনুসারে, গত বছর ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা নয় কোটি ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে ৭০ শতাংশই সাইবার অপরাধের ঝুঁকিতে আছেন। ব্যবহারকারীদের মধ্যে ২০ শতাংশই কোনো না কোনোভাবে সাইবার অপরাধের সঙ্গে জড়িত। মাত্র ১০ শতাংশ ব্যবহারকারী সাইবার নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতন। একই তথ্যানুসারে, দেশে এখন ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় তিন কোটি। আর সাইবার অপরাধের ৭৫ শতাংশই অভিযোগই ফেসবুককেন্দ্রিক। ইন্টারনেটের মাধ্যমে হয়রানি ও প্রতারণার শিকার হওয়া ৪৯ শতাংশই স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী।
দীর্ঘদিন ধরে আরও কিছু প্রতারণা প্রচলিত আছে। ই-মেইলে বিপুল সম্পদ উইলের প্রলোভন দিয়ে মেইল, পরিচিত কারও ই-মেইল আইডি হ্যাক কিংবা একই ধরনের আইডি তৈরি করে বিদেশে বিপদে পড়ার নামে টাকা চাওয়া, ফেসবুকে পরিচিত বন্ধুর পরিচয়ে স্প্যাম লিংক ছড়িয়ে দেয়া ইত্যাদি। বিশেষত, ফেসবুক, ই-মেইলে স্প্যাম লিংক পাঠিয়ে কম্পিউটারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অনলাইন ব্যাংকিংয়ের পাসওয়ার্ডসহ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চুরি করা হচ্ছে।
কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য ছাড়াও ফটোশপে কারসাজি করে বানানো আপত্তিকর ছবি দিয়েও হেয় করার চেষ্টা করা হয় অনেককে৷ এমনকি ফেসবুকে প্রতিপক্ষকে হেয় করতে মিথ্যা ও ভুয়া খবরও ছড়ানো হয়৷
পুলিশের ক্রাইম ডেটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের (সিডিএমএস) পরিসংখ্যান ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ছয় বছরে সাইবার অপরাধের ঘটনায় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় মামলা হয়েছে চার হাজারের বেশি। এর মধ্যে সাইবার ট্রাইব্যুনালে গেছে দেড় হাজারের বেশি মামলা। নিষ্পত্তি হয়েছে পাঁচ শতাধিক। এর মধ্যে মাত্র দুই শতাংশ মামলায় আসামিদের সাজা হয়েছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স শাখার উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) ওয়ালিদ হোসেন সারাক্ষণকে বলেন, ‘প্রতারণা বাঙালির অনেকেরই অস্থিমজ্জায়। প্রতারণার ক্ষেত্রে প্রতারকের যেমন দক্ষতা আছে, যারা প্রতারিত হচ্ছেন, তাদের বোকামিও আছে। অনেক ক্ষেত্রে তাদের লোভও কাজ করে। এই ধরনের লোভ যতোদিন থাকবে, ততোদিন প্রতারণাও থাকবে। প্রতারণা বন্ধ করা বড় কঠিন।’
তিনি বলেন, ‘এখন ডিজিটাল যুগ, টাকা-পয়সার লেনদেন, ব্যাংকিং ব্যবস্থা, বিকাশ, রকেট, নগদের মাধ্যমে বেশি হয়। সেই হিসবে আমি মনে করি, প্রতারণার বেশি ভাগই এখন হয় অনলাইনে।
অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের প্রধান অতিরিক্ত ডিআইজি রেজাউল হায়দার বলেন, ‘প্রতারণা সারা বিশ্বেই আছে, বাংলাদেশেও আছে, সব জায়গাতেই হচ্ছে। একদম অপরাধ নেই- বিশ্বের এমন কোনো জায়গা পাওয়া যাবে না। অপরাধীরা অপরাধ করবেই, আমরা অভিযান পরিচালনা করবো। এতে আমাদের সক্ষমতা বাড়বে। তারা নতুন করে টেকনিক আবিষ্কার করবে। তারপর আবার তাদেরকে ধরবো। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। কিন্তু আমাদের যদি অভিযানটা ফলপ্রসূ হয় তাহলে এটি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। অপরাধীরা সব সময় অপরাধের জন্য সুযোগ খুঁজবে, এটিই নিয়ম।’
উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘যিনি বেড়া তৈরি করেছেন, তিনি তার ফাঁক খোঁজেন না। যিনি সব সময় চুরির জন্য বেড়ায় ফাঁক খোঁজেন, তিনিই খোঁজ রাখেন। নরমালি আমরা যে অ্যান্টিভাইরাস ব্যবহার করি, তাও কিন্তু সব সময় আপডেট করতে হয়। কারণ, অ্যান্টিভাইরাসে প্রথম যা ছিল, হ্যাকাররা তার থেকেও নতুন আরেকটা বানিয়ে ফেলেছে। হ্যাকারদের ওইটাকে ঠেকাতে আমাদেরকেও আপডেট করতে হয়। এসব থেকে বোঝা যায়, আগে অপরাধ হয়, তারপর প্রতিকারের ব্যবস্থা করা হয়। আমরাও চেষ্টা করবো, সাইবার অপরাধীদেরকে থামিয়ে রাখার। গ্লোবালি এটি নিয়ম। তারাও আবার নতুন কোনো মাধ্যমে চেষ্টা করবে অপরাধ করতে। এসব ক্ষেত্রে সিকিউরিটি যদি স্ট্রং থাকে, তাহলে এসব অপরাধ করার সুযোগও কম থাকে।’
তিনি বলেন, ‘গ্লোবালি যারা নামকরা হ্যাকার, অবশ্যই তাদের অনেক দক্ষতা আছে। কিন্তু তারা তাদের বুদ্ধি ভালো কাজে ব্যবহার করেন না।’
রেজাউল হায়দার বলেন, ‘গত এক বছরে এক হাজারের বেশি প্রতারণার মামলার তদন্ত করেছি। তার মধ্যে দশ শতাংশই অনলাইনে প্রতারণার।’
দুই বছর আগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হয়েছে। সাইবার অপরাধ দমনে সরকার নানা ধরনের উল্লেখযোগ্য উদ্যোগও নিয়েছে। সাইবার ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। কাজেই শুধু আইন করে বা ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বসে থাকলে চলবে না। আইনের যথাযথ প্রয়োগও এ ক্ষেত্রে জরুরি বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।