মদ তৈরিতে বিষাক্ত কেমিক্যাল ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব কেমিক্যাল মানবদেহে প্রবেশ করা মাত্র গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বিকল হচ্ছে। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা জানিয়েছেন, দেশে বিদেশি মদের সরবরাহ কম থাকায় এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে ভেজাল মদ তৈরি করছে। সেবনকারী কোথাও বিদেশি মদ না পেয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে এসব মদ সংগ্রহ করে সেবন করছে। যত্রতত্র গড়ে ওঠা ভেজাল মদ তৈরি হচ্ছে পানি, চিনি, রঙ আর স্পিরিট দিয়ে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার গুলশান বিভাগ গত সোমবার একটি ভেজাল মদের কারখানায় অভিযান চালিয়ে মূল হোতাসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে। তারা হলেন, কারখানার মালিক নাসির উদ্দিন, চিফ কেমিস্ট জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী কেমিস্ট আল আমিন, পাইকার রিদওয়ান, খুচরা বিক্রেতা আকাশ ও সাত্তার। তাদের কারখানাটি ছিল ভাটারা এলাকার চেয়ারম্যান গলির একটি বাড়িতে।
ডিবির গুলশান বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, অভিযান করতে গিয়ে ওই বাসায় একটি ডায়েরি মিলে। ওই ডায়েরিকে আমরা আলামত হিসেবে ব্যবহার করি। কারণ ওই ডায়েরিতে তারা গত কয়েক মাস ধরে কোথায় কার কাছে মদ বিক্রি করেছে তার তথ্য পাই। গত কয়েকদিনে যতগুলো মদ খেয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল সেগুলো ভেজাল মদের কারণেই হয়েছিল। এবং ওইসব স্থানে যে ধরনের মদ পাওয়া গেছে সেগুলো এই কারখানায় প্রস্তুতকৃত মদের মতই। ডিবি জানায়, এই কারখানার চিফ কেমিস্ট জাহাঙ্গীর মিটফোর্ড থেকে মদের বোতল, নিমতলী থেকে স্পিরিট, চকবাজার থেকে পানি ও রঙ কিনতো। পরে এসবের সংমিশ্রণে ভেজাল মদ তৈরি করতো। এক গ্যালন স্পিরিট দিয়ে ১০০ বোতল মদ তৈরি করতো। তারা বোতলের লেভেল, ছিপি এমনভাবে লাগাতো দেখে বোঝার উপায় থাকতো না এটি হ্যান্ড মেকিং মদ। এই কারখানা থেকে তারা বিদেশি সব ব্র্যান্ডের নকল ও ভেজাল মদ তৈরি করে বিক্রি করতো।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের জানা গেছে, তিন বন্ধু মিলে ভাটারার নূরের চালা এলাকার একটি বাসায় ভাড়া থাকতেন। তাদের মধ্যে এক তরুণী ও দুইজন তরুণ। দুই তরুণের মধ্যে একজনকে তন্বী নামের তরুণীর স্বামী হিসেবে পরিচয় দিতেন। গত ১৮ই জানুয়ারি তন্বী হঠাৎ অসুস্থ হলে দুই বন্ধু নাঈম ও অভি তাকে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যান। অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়াতে সেখান থেকে তাকে নেয়া হয় মহাখালীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে। কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তন্বীকে মৃত ঘোষণা করেন। এরপর তন্বীর মৃতদেহ নিয়ে নাঈম ও অভি তার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহে যান। সেখানে মরদেহের সৎকার করা হয়। তন্বীর মরদেহের সৎকারের পরপরই অসুস্থ হয়ে পড়েন নাঈম ও অভি। একপর্যায়ে দু’জনই সেখানে মারা যান। পুলিশ তাদের বাসা থেকে মদের বোতল সংগ্রহ করে ফরেনসিক ল্যাবে পরীক্ষা করে জানতে পারে ওই মদ ছিল বিষাক্ত। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন বিষাক্ত কিছু পান করার কারণে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে।
বিষাক্ত মদ খেয়ে গত রোববার রাতে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে নদী এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন মারা গেছেন। মামুন তার বন্ধু কাজী শেহজাদ টনিকে নিয়ে বারিধারার অফিসে মদ খেয়েছিলেন। এরপর থেকে তিনি অসুস্থতা বোধ করেন। পরে তাকে ভর্তি করা হয় ইউনাইটেড হাসপাতালে। সেখানেই তিনি মারা যান। মামুনের বন্ধু টনি এখনো অসুস্থ। ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, মামুন ও টনি টেলিফোনে এক মদের কারবারির কাছ থেকে ওই মদ নিয়েছিলেন।
গত শুক্রবার উত্তরার ব্যাল্ফুব শট নামে একটি রেস্তরাঁয় পার্টিতে বিষাক্ত মদ খান ধানমণ্ডির একটি বেসরকারি ইউনিভার্সিটির পাঁচ বন্ধু। তাদের মধ্যে আরাফাত ও তার বান্ধবী এরইমধ্যে মারা গেছেন। চিকিৎসকরা বলছেন, বিষাক্ত মদপানের কারণেই তারা মারা গেছেন। এ ছাড়া গাজীপুরের একটি রিসোর্টে গত সোমবার পার্টির আয়োজন করেছিল ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। পুরান ঢাকা থেকে সেখানে মদ সরবরাহ করেছিল একটি চক্র। ওই মদের পার্টিতে অংশ নেয়া তিনজন এরইমধ্যে মারা গেছেন। অসুস্থ হয়ে পড়েছেন আরো অন্তত ১০ জন। বগুড়ায় বিষাক্ত মদপানে একই পরিবারের ৩ সদস্যসহ মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ জনে।
গত রোববার সকালে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার দুই কর্মী শিহাব জহির ও মীর কায়সার। তাদের মৃত্যুর পেছনেও দায়ী অতিরিক্ত মদপান। এ ছাড়া ওই ঘটনায় অসুস্থ হয়ে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন সংস্থাটির একাধিক কর্মী। গত শুক্রবার প্রতিষ্ঠানটির ৪৩ কর্মী গাজীপুরের সারাহ রিসোর্টে যায়। সেখানে কর্মীরা মদপানের পরিকল্পনা করেছিলেন। তবে ঢাকার কোনো বারে মদ না পেয়ে তারা গাজীপুরে গিয়ে স্থানীয় একজনকে দিয়ে মদ কিনে আনান। মদ খেয়ে ঢাকায় ফেরার পথে গাড়িতেই তারা অসুস্থ হয়ে পড়েন।
থার্টিফার্স্ট নাইট উদ্যাপন উপলক্ষে ১লা জানুয়ারি রাতে রাজশাহীর হোসনীগঞ্জ এলাকায় মদপান করে অসুস্থ হয়ে পড়েন কয়েকজন। এদের মধ্যে ৫ জন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ২রা জানুয়ারি। গত ৯ই জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে মদপানে অসুস্থ হয়ে ঢাকার বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে ছাত্রলীগের তিন নেতাকর্মীসহ ৪ জনের মৃত্যু হয়।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার (ডিবি) উপ-পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, সম্প্রতি মদ খেয়ে বেশকিছু মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। সেগুলোর তদন্ত করতে গিয়ে আমরা ভেজাল মদের কারখানার সন্ধান পেয়েছি। আমরা কারখানায় অভিযান চালিয়ে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছি। তারা পানি, চিনি, স্পিরিট আর রঙ দিয়ে মদ তৈরি করে। মদের মধ্যে স্পিরিট থাকার কারণে মানুষ মারা যাচ্ছে। তিনি বলেন, ঢাকায় যারা যে ধরনের মদ খেয়ে মারা গেছে আমরা সেটির সঙ্গে ওই কারখানার মদ মিলিয়ে দেখেছি। সবগুলো মদের ধরন একই। ওই কারখানার পাইকার ও খুচরা বিক্রেতারা এসব মদ বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করেছে।