ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে যশোরে আসা নৈশকোচের যাত্রীরা এই সিন্ডিকেটের হাতে নাজেহাল হওয়াসহ সর্বস্ব খুইয়ে বাড়ি ফিরছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কতিপয় সদস্যর যোগসাজসে দড়াটানা ও এর আশপাশের এলাকায় রীতিমত বিভীষিকা তৈরি করেছে সিন্ডিকেটটি। পরিবহন সেক্টরের সাথে সম্পৃক্ত না থাকা সত্ত্বেও এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা নৈশকালীন যাত্রীদের বাড়ি পৌঁছে দেয়ার ‘মহান দায়িত্ব’ পালন করতে যেয়ে হাতিয়ে নিচ্ছেন বিপুল অংকের টাকা। তাদের মাধ্যমে ছাড়া কোনো পরিবহণে যাত্রী ওঠানোও সম্ভব হয় না এখান থেকে। কথিত এই সিন্ডিকেটের নাম ‘মনির মেম্বর সিন্ডিকেট’। বিষয়টি নিয়ে একাধিক যাত্রী ও স্থানীয়দের কাছ থেকে একের পর এক অভিযোগ পাওয়ার পর সরেজমিন টানা তিন রাত অনুসন্ধান চালানো হয়। তাতেই বেরিয়ে আসে কথিত এই সিন্ডিকেট সদস্যদের রামরাজত্বের নানা ফিরিস্তি।
অনুসন্ধানকালে জানা যায়, চক্রের হোতা মনির ওরফে মনির মেম্বর নিজেকে শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাসহ নানা পরিচয় দিয়ে দড়াটানা ভৈরব চত্বরকেন্দ্রীক শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। সিন্ডিকেটের সদস্যদের রয়েছে নিজস্ব পিয়াজো গাড়ি, ইজিবাইক, অটোরিকশা, রিকশাসহ একাধিক মোটরসাইকেল। ওইসব যানবহনে রাত ১২টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন এলাকা দাপিয়ে বেড়ান তারা। যশোরে আসা দূরপাল্লার যাত্রীরা তাদের প্রধান টার্গেট। শুধু চাঁদাবাজি নয়, সুযোগ পেলে জিম্মি করেও টাকা আদায় করা হয় যাত্রীদের থেকে। চাহিদামতো টাকা না দিলে অবরুদ্ধ করে রাখা হয় যাত্রীদের।
দড়াটানা চত্বরে যাত্রীদের বসার জন্য নির্দিষ্ট স্থান না থাকায় নৈশকালীন যাত্রীরা আশপাশের দোকান বা ভবনগুলোর সামনে আশ্রয় নেন। এ সুযোগে মনির সিন্ডিকেট তাদেরকে জিম্মি করে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার নামে ভাড়া হিসেবে ইচ্ছামত টাকা আদায় করে। কোনো যাত্রী মনির সিন্ডিকেটকে টাকা না দিয়ে এখান থেকে বাসে উঠতেও পারেন না। ওই টাকার একটা বড় অংশ নিজেরা রেখে বাসের সুপারভাইজারকে ভাড়া পরিশোধ করে সিন্ডিকেট সদস্যরা।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, পুরাতনকসবা ফাঁড়ি ও সদর ফাঁড়ির কপিতয় পুলিশ সদস্যর সাথে সখ্য গড়ে তুলে চক্রের সদস্যরা যাত্রীদের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছেন। কখনো কখনো পুলিশের সামনেই ঘটে এসব অপকর্ম।
৩ মার্চ বুধবার দিবাগত রাত ৩টায় যাত্রী সেজে ভৈরব চত্বরে যেয়ে অন্তত ২০ জন যাত্রীকে বিভিন্ন দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তাদের অর্ধেকের বাড়ি শহরে। অন্যরা নতুন বাসে ওঠার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। এসময় মনির সিন্ডিকেটের সদস্যরা যাত্রীদের সাথে কড়া মেজাজে কথা বলছিলেন।
রাত ৩টা ১৪ মিনিটে পাইকগাছাগামী রোজিনা এক্সপ্রেসের একটি বাস (ঢাকা মেট্রো ব-১৫২৬৮৯) দড়াটানা চত্বরে আসতেই সামনে ছুটে আসেন মনির মেম্বর। তার হাতের ইশারায় সিদ্দিক বেকারির সামনে অবস্থান নেয় পরিবহনটি। সুপারভাইজার নেমে দাঁড়াতেই পাঁচজন যাত্রীকে বাসে উঠিয়ে দেন মনির। পরে তার সাথে লেনদেন শেষ করে বাস ছাড়ার সিগন্যাল দেন সুপারভাইজার।
ওই বাস থেকে দড়াটানায় নামেন সাত যাত্রী। মনিরের প্রশ্নের উত্তরে তাদের চারজন জানান বাড়ি যশোর শহরে। বাকিরা অন্য গাড়িতে খুলনায় যাবেন। সিন্ডিকেটের সদস্য কাজীপাড়ার মুন্না যাত্রীদের জানান, তাদের মাধ্যমে না গেলে অন্য কেউ নিয়ে যাবে না। তাদের মাধ্যম ছাড়া শহরের কোথাও গেলে যাত্রীরা বিপদে পড়বেন বলেও হুমকি দেখান তিনি। তার কথায় সায় দেন পাশে দন্ডায়মান চক্রের আরও দু’সদস্য মাহবুব ওরফে মাওলা ও মিজান। তাদের কথায় হতভম্ব হয়ে যাওয়া যাত্রীরা এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে মনিরের চাহিদা মেনে নেন। টাকা বুঝে নিয়ে মনির যাত্রীদের একজনকে মোটরসাইকেলে ও একজনকে রিকশায় উঠিয়ে দেন।
খুলনার যাত্রীদের জনপ্রতি দুশ’ ৫০ টাকা নির্ধারণ করে মনির চলে যান পাশের রেজাউলের দোকানে। সেখানে অপেক্ষা করছিলেন পুরাতন কসবা ফাঁড়ির এটি এস আই সমাপ্ত। তাদের সাথে যোগ হন আরও কয়েকজন। ড্রাইকেক, চা ও সিগারেট খেয়ে পি এস আই সমাপ্ত মনিরকে নিয়ে যান অন্ধকারে। সেখানে গোপন কথা সেরে চলে যান সমাপ্ত। অপর পাশের শামসুর দোকান ও সাকো বেকারির সামনে ফের অবস্থান নেন পালের গোদা মনির। পাশেই মুন্না, মাওলা, মিজানের মত আরও কয়েকজন ‘শিকারির’ অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকেন।
একই রাত ৩টা ২২ মিনিটে দড়াটানায় আসে সোহাগ পরিবহনের একটি বাস (ঢাকা মেট্রো ব-১৪৭৩৪৩)। ৩টা ৪৭ মিনিটে দেশ ট্রাভেলস এর এসি কোস (খুলনা মেট্রো ব-১৪৮৮০১), ৩টা ৪৮ মিনিটে এম আর এক্সক্লুসিভ পরিবহন (যশোর ব-১১০১৭৫), চাকলাদার পরিবহন (যশোর ব-১১০১৮২), ৩টা ৫০ মিনিটে হানিফ পরিবহন (ঢাকা মেট্রো ব-১৪৮৩১৭), ৪টায় সোহাগ লাইট (ঢাকা মেট্রো ব ১৪৬১৯৫) ৪টা ১০ মিনিটে ঈগল পরিবহন (ঢাকা মেট্রো ব ১৫১৬৭৫), ৪টা ২০ মিনিটে সাতক্ষীরা লাইনসহ (ঢাকা মেট্রো ব ১৫৭৫৪৪)। এসময় একের পর এক আরও বাস আসে। এসব বাস থেকে নামা বা বাসে ওঠা সকল যাত্রীকেই একইভাবে মনির সিন্ডিকেটকে তুষ্ট করতে হয়। এরই মধ্যে আকস্মিকভাবে কয়েকটি মোটরসাইকেলে সেখানে নিয়ে আসা হয় বেশ কয়েকটি কার্টন। এসব কার্টন মনির সিন্ডিকেটের সদস্যরা বাসের সুপারভাইজারদের হাতে তুলে দেয়ার পর টাকার লেনদেন সারেন। অভিযোগে জানা যায়, এসব কার্টনে অবৈধ মালামাল পাচার করা হয়।
আশরাফুল, ফরিদ হাসান, মনিরুল ইসলাম, শারমিন নামে খুলনার যাত্রীরা জানান, তাদের কাছ থেকে সিন্ডিকেটের সদস্যরা মাথাপ্রতি ভাড়া হিসেবে দুশ’ থেকে দুশ’ ২০ টাকা আদায় করেছেন। যশোর থেকে খুলনায় যাওয়ার জন্য সুপারভাইজাররা তাদের কাছ থেকে একশ’ টাকার বেশি নেন না। এসময় কয়েকজন যাত্রী অভিযোগ করেন, মনিরসহ চক্রের সদস্যরা তাদের মাধ্যমে গন্তব্যে না গেলে ক্ষতি করার হুমকি দেন। এ নিয়ে তাদের বাকবিতন্ডা হয়। তখন এটিএস আই সমাপ্ত এসে মনিরকে নিয়ে খেলাঘরের সামনে যান। সেখানে বসে পুলিশের পিয়াজু গাড়ির চালক হাফিজুরকে দিয়ে শরীর ও মাথা টিপিয়ে নেন তিনি।
কয়েকজন বাস চালক জানান, যাত্রীদের কাছ থেকে নির্ধারিত ভাড়া নেন তারা। বাড়তি টাকা রেখে দেন মনির। তারা বলেন, গাড়িখানায় বাস দাঁড় করাতে পারলে তাদের ভালো হয়। কিন্ত, মনির সিন্ডিকেট তাদেরকে দড়াটানায় দাঁড়াতে বাধ্য করেন।
মনির মেম্বর নিজেকে নির্দোষ দাবি করে নিজেকে শ্রমিক নেতা পরিচয় দেন। তিনি বাড়তি টাকা নেননা বলেও দাবি করেন।
এটিএস আই সমাপ্তের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনিও মনিরকে নির্দোষ দাবি করেন। নিজেও এসব কাজের সাথে জড়িত নন বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।
যশোর কোতোয়ালি থানার ওসি তাজুল ইসলামের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, তিনি কোতোয়ালি থানায় কয়েকদিন আগে যোগদান করেছেন, বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন।
যশোর জেলা পরিবহন সংস্থা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আজিজুল আলম মিন্টু ও সাধারণ সম্পাদক সেলিম রেজা মিঠু জানান, মনির নামে তাদের কোনো শ্রমিক নেই যে দড়াটানায় অবস্থান নেন। এ বিষয়ে তারা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।