শ্রমিক, কৃষকসহ মেহনতী মানুষগুলো যখন কুঁজো হয়ে যাচ্ছিল, মেহনতীদের ঘাড় ভেঙে পুঁজিপতি সুবিধাবাদী জাররা মুঠি ভরে নিত; ঠিক সে সময় রাশিয়ার মহানদী ভলগার তীরে এই মহান নেতার জন্ম।
লেনিন এর পিতা ইলিয়া নিকোলায়েভিচ উইলিয়ানভ ছিলেন মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক। মা-মারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা পড়াশোনা করেন বাড়ীতে। কয়েকটি বিদেশী ভাষা জানতেন, সাহিত্যে তার ভালো দখল ছিল।
ইলিয়া ও মারিয়া উইলিয়ানভ পরিবারে ছেলেমেয়ে ছিল মোট ছয় জন। বাবা-মা তাদের জন্য বহুমুখী শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন, চেয়েছিলেন তাদের সৎ ,বিনয়ী, পরিশ্রমী, জনগনের অভাব অনটনের প্রতি সজাগ করে তুলতে। পাঁচ বছর বয়সেই ভ্লাদিমির পড়তে শেখে, নয় বছর বয়সে ভর্তি হয় সিমবির্স্ক জিমনেসিয়মের প্রথম শ্রেণীতে। পড়াশোনায় ভ্লাদিমির ছিলেন খুবই মনোযোগী। ক্লাসের পর ক্লাস উত্তীর্ন হয়ে এল ভ্লাদিমির প্রথম শ্র্রেণীর পুরস্কার পেয়ে।
অনেক পড়াশোনা করেন ভ্লাদিমির । রুশ মহান লেখকদের রচনা তার পাঠ্য সম্ভারে জড়িয়ে ছিল। তার পঠিত সাহিত্যের মধ্যে একটা বড় অংশ জুড়ে ছিল বিপ¬বী গণতন্ত্রী লেখকরা। এদের অনেকের লেখা তখন নিষিদ্ধ ছিল তবু ভ্লাদিমির তা বাদ দেননি। লেলিনকে খুবই আকৃষ্ট করত ন.গ. চেনিশের্ভস্কির “What’s the Duty” উপন্যাস। ভ্লাদিমির লেলিনের মতে কঠোর সেন্সর সত্বেও চেনিশের্ভস্কি তার প্রবন্ধ মারফত সত্যিকার বিপ¬বী গড়ে তুলতে পেরেছিলেন।
কিশোর লেলিনের চরিত্র ও দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে উঠে রুশ সাহিত্য ও পরিবেশের জীবন পর্যবেক্ষনের প্রভাবে। এসময় পুঁজিবাদ দ্রুত বিকাশ পাচ্ছিল, যান্ত্রিক টেকনোলজি ও হাজার হাজার মজুর নিয়ে মাথা তুলছিল কলকারখানা। সংগে যোগ হয়েছিল অভিশপ্ত ভূমিদাস প্রথা ।
লেনিনকে আরো আলোড়িত করে ১৮৮৭ সালে যখন তার দাদা আলেক্সান্দর উইলিয়ানভ জার তৃতীয় আলেক্সজান্ডারকে হত্যা করার অভিযোগে সেই বছরের মার্চে গ্রেপ্তার হন এবং মে’তে তিনি মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হন। দাদার মৃত্যুর পর লেলিন বিপ্লবী সংগ্রামে নিজেকে উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নেন।
তেইশ বছর বয়সী লেলিন গ্রাম্য জীবনকে স্বচক্ষে পর্যবেক্ষন করতেন। প্রায়ই কৃষকদের সম্বন্ধে আলাপ করতেন, তাদের অবস্থার খোঁজখবর নিতেন। সামারা, কাজান, সারাতভ, সিজরান প্রভৃতি এলাকাসহ ভলগা তীরের অন্যান্য শহরে মার্কসবাদীদের সংগে যোগাযোগ স্থাপন করে পরবর্তী বিপ্লবী অভ্যুথানের জন্য সক্রিয় হতে থাকেন।
১৮৯৬ সালে গ্রীষ্মে ‘সংগ্রাম সংঘ’এর নেতৃত্বে পিটার্সবুর্গে সুতাকল শ্রমিকদের একটি বিখ্যাত ধর্মঘট সংঘটিত হয়, তাতে যোগ দেয় ত্রিশ হাজারেরও বেশী নরনারী শ্রমিক। এ ক্রিয়াকলাপের ফলে জার সরকার লেলিনসহ দলের অধিকাংশ নেতা কর্মীদের গ্রপ্তার করেন। জেলে থেকেও তিনি বিপ্লবী ক্রিয়াকলাপ থেকে বিরত থাকেননি। জার সরকার ১৮৯৭ সালে লেনিনকে ৩ বছরের জন্য সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত করেন । তবু তিনি ভেঙ্গে পড়েননি।
১৯০০ সালের ২৯ জানুয়ারী নির্বাসনের মেয়াদ শেষ হলে তিনি সস্ত্রীক প্রচন্ড শীতে প্রায় ৩২০ কিলোমিটার ঘোড়ায় চেপে দিন-রাত সমানে পথ চলেন।
১৯১৪ সালের প্রথমার্ধে রাশিয়ায় বিপ্লবী আন্দোলন ক্রমেই ব্যাপক হয়ে উঠল এবং পনের লক্ষ শ্রমিক ধর্মঘট করে। অর্থনৈতিক ধর্মঘটের সাথে রাজনৈতিক ধর্মঘট জড়িয়ে পড়েছিল। এই ১৯১৪ সালেরই গ্রীষ্মে দুই সম্রাজ্যবাদী দলের মধ্যে শুরু হয় প্রচন্ড লড়াই। এদের এক দলে জার্মানি ও অস্ট্রো হাঙ্গেরি এবং অন্যদলে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও রাশিয়া। পরে যুদ্ধে যোগ দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অন্যান্য রাষ্ট্র। যুদ্ধ হয়ে উঠল বিশ্ব যুদ্ধ।
যুদ্ধের বিরোধিতা করায় অস্ট্রিয় সরকার তাঁকে মিথ্যা রিপোর্টে গ্রপ্তার করান জার সরকারের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে। অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হলে অস্ট্রিয়ার সামরিক কর্তারা লেলিনকে দুই সপ্তাহ্ পর মুক্তি দিতে বাধ্য হন। প্রায় দশ বছর পর ১৯১৭ সালের ৩ এপ্রিল রাতে লেনিন রাশিয়ায় পৌছান। সেখানে বিপ্লবের দ্রুত বিকাশ দেখে লেলিন শ্রমিক শ্রেণী ও গরীব কৃষকদের সশস্ত্র অভ্যুত্থানের জন্য তৈরী হতে বলেন। লেনিনের সশস্ত্র অভ্যুত্থান, প্রলেতারীয় একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার আহবান সমর্থন করে দেশে ২৫০টির বেশী সোভিয়েত।
লেনিন ও বলশেভিক পার্টির নেতৃত্ব শ্রমিক, লালরক্ষী, সৈন্য ও নাবিকদের আত্মৎসর্গী সংগ্রাম ও বিরত্বের ফলে বিশ্ব ইতিহাসে এক মহাসাফল্যের ঘটনা ঘটে। জমিদার ও পুঁজিবাদ ধ্বংস হয়। ২৫ অক্টোবর সকাল ১০টায় পেত্রগ্রাদ সোভিয়েতের অধীনস্থ সামরিক বিপ্লব কমিটি লেনিনের বিবৃতি প্রকাশ করে ঘোষনা দেয় লড়াই সফল হয়েছে। এদিন সন্ধ্যায় শুরু হয় দ্বিতীয় সোভিয়েত কংগ্রেস। এতে নানা অঞ্চল থেকে ৬৫০ জন প্রতিনিধি অংশ নেয়, যার মধ্যে ৪শ’ জনই বলশেভিক।
২৬ অক্টোবর কংগ্রেসে লেনিনের বক্তৃতা উল্লাসে অভিনন্দিত করে প্রতিনিধিরা। ‘লেনিন যেই মঞ্চে এলেন অমনি সমস্ত সভাকক্ষ উঠে এগিয়ে যায় লেনিনের দিকে। অবিরাম করতালি আর লেনিন জিন্দাবাদ ধ্বনিতে মুখরিত প্রাঙ্গনে তিনি বহুক্ষন বক্তৃতা শুরু করতে পারেননি।’
এভাবেই যাত্রা শুরু হয় সমাজ তান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের। ১৯২৩ সালের মার্চের গোড়ায় লেনিনের শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে আসে। মে মাসে উনি গোর্কিতে ফিরে যান। অবশেষে ১৯২৪ সালের ২১ জানুয়ারী সন্ধ্যা ৬টা ৫০ মিনিটে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরনের ফলে মারা যান লেলিন। আর সেই সাথে অবসান হয় একটি বিপ্লবী চরিত্রের, একজন রাষ্ট্র নায়কের, এক মেহণতীদের নেতার।
২৩ জানুয়ারী লেলিনের শবাধার গরইক থেকে মস্কোয় এনে ইউনিয়ন ভবনের সভা কক্ষে রাখা হয়। সকল স্তরের নর-নারীরা স্তম্ভ কক্ষের ভিতর দিয়ে প্রদক্ষিন করে লেলিনকে তাদের শেষ শ্রদ্ধা জানান। ২৭ জানুয়ারী বিকাল চারটায় লেলিনের সমাধি অনুষ্ঠান শুরু হয়। ক্রমলিনের দেয়ালের কাছে, বিশেষভাবে নির্মিত ম্যুজোলিয়ামে স্থাপিত হয় লেলিনের দেহ। তখন সমস্ত কাজ পাঁচ মিনিটের জন্য বন্ধ ঘোষনা জানালো আন্তর্জাতিক
প্রলেতারিয়েত। থেমে গেল মোটর, ট্রেন, বন্ধ রইল কলকারখানার কাজ। পেত্রগ্রাদের নাম হয় লেনিন গ্রাদ। গভীর শোক নিয়ে এভাবেই প্রাণের নেতাকে চির বিদায় দিল সোভিয়েত জনগণ।