সোমবার এ সালিশে তাদের জুতাপেটা করার পর জুতার মালা পরিয়ে এলাকায় ঘোরানো হয় এবং ঘরে তালা ঝুলিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় জড়িত ৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, মাদারীপুর সদর উপজেলার পেয়ারপুর গ্রামের মনির মিয়ার (৪০) সঙ্গে রাজৈর উপজেলার বাজিতপুর ইউনিয়নের সুতারকান্দি গ্রামের ওই নারীর সঙ্গে ধর্ম আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে। ধর্ম ভাই-বোন হিসেবে তারা উভয়ের বাড়িতে যাতায়াত করতো। ১৯ এপ্রিল মনির মিয়া তার বোনের বাড়ি বেড়াতে আসেন। কিছুক্ষণ পর বাড়ির পাশের কালু ফকির, ইমরান ফকির, শাকিব আকন, রানা ফকির, শামীম ফকিরসহ ৮-১০ জন ওই নারী ও মনিরকে ঘর থেকে টেনে বাইরে বের আনে।
পরে তাদের বেঁধে রেখে বাড়ির উঠানে সালিশ বসায়। সালিশে কালু ফকির কারো কথা না শুনে ওই নারী ও মনিরকে ১০০ বার জুতাপেটা করে।পরে জুতার মালা পরিয়ে তাদের এলাকা ঘুরানো হয়। এক পর্যায়ে তাদের ঘরে তালা ঝুলিয়ে এলাকা থেকে বের করা ও সমাজচ্যুত করা হয়। কিন্তু প্রভাবশালীদের ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস পায়নি।
ভুক্তভোগী গৃহবধূ বলেন, ‘ওরা আমাকে ও আমার ভাইকে জোর করে বাইন্দা গ্রামের সবার সামনে ১০০ জুতার বাড়ি দিছে, জুতার মালা পরাই সারা গ্রাম ঘুরাইছে। আবার মোর ঘরে তালা দিছে। এহন আমরা ওগো ভয়তে গ্রামছাড়া। ওদের ডরে নিজের ঘরে যাইতে পারি নাই। এহন হুনছি ওরা নাকি আমাগো সমাজেরতোন বাইর কইরা দিবে। এই অপমানের পর আরকি বাইচ্যা থাকতে ইচ্ছা করে। গেছিলাম মরতে তয় মেম্বার কইছে, আমার অপমানের বিচার কইরা দিবো, হেই কারণে মরি নাই। যদি বিচার না পাই তাইলে আমি আর দুনিয়ায় থাকুম না।’
এলাকার মেম্বর তারা মিয়া বেপারী বলেন, ‘ধর্মের ভাইবোনকে কথিত বিচারের নামে একটি প্রহসনের সালিস বসায়। সালিসে এলাকার মেম্বর হিসেবে আমার কোনো কথাই তারা শোনেনি। এমনকি ভুক্তভোগী ওই নারীর কোনো কথা না শুনে কালু ফকির, ইমরান ফকির, শামীম ফকির, রানা ফকির গং নিজেদের ইচ্ছামতো রায় ঘোষণা করে।’
তারা মিয়া বেপারী আরও বলেন, ‘কথিত বিচারে ওই নারী ও তার ধর্ম ভাই মনিরকে ১০০ জুতা পেটা ও জুতার মালা পরিয়ে সারা এলাকায় ঘুরানোর রায় দেওয়া হয়। সাথে সাথে কালু, ইমরান, রানা গংরা তাদের বেঁধে উভয়কে ১০০ করে জুতা পেটা করে। এ সময় ওই নারীর আত্মচিৎকার ও আর্তনাদে এলাকার বৃদ্ধ-বণিতার চোখে পানি আসলেও কথিত সমাজপতি মাতব্বরদের মন গলেনি। একপর্যায় সমাজপতিরা তাদের জুতার মালা বানিয়ে তাদের গলায় পরিয়ে পুরো এলাকায় ঘুরায়।’
বাজিতপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম হাওলাদার বলেন, ‘জঘন্যতম কাজটি যারা করেছে, যারা আইনকে নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছে। তাদের এবং এর পেছনে ইন্ধনদাতাদেরও বিচার হওয়া উচিত।’
ভুক্তভোগী গৃহবধূর স্বামী বলেন, ‘আমি আইজ দীর্ঘ ৩৬ বছর ধরে আমার স্ত্রী খোদেজা বেগমকে নিয়ে ঘর-সংসার করে আসছি। তার চরিত্র খারাপ হলে আমিই আগে জানতাম। যদি আমার স্ত্রী কোনো অপরাধ করে থাকে তাহলে বিচার করতাম। উনারা কেন আমার স্ত্রী ও আমার আত্মীয়কে জুতাপেটা করে জুতার মালা পরিয়ে এলাকা ঘুরাল? এখন তারা বিচারের নামে আমাগো ঘরে তালা দিয়ে বের করে দিল। আমি ও আমার স্ত্রী ঘরে যেতে পারছি না। আমাগো সমাজচ্যুত করার হুমকি দিচ্ছে ভয়ে আমরা কিছুই করতে পারছি না। আমার ছেলেমেয়ে আছে, তাদের বিয়ে দিয়েছি, নাতি-নাতনি রয়েছে। আমারা কিভাবে মানুষরে মুখ দেখাব। আমি এর বিচার চাই।’
সালিসের প্রধান হোতা কালু ফকির গ্রেপ্তারের পর বলেন, ‘ওই মহিলা খুবই বাজে চরিত্রের লোক। তাই একটু শাসনের জন্য সালিস করা হয়। সালিসে অনেক মাতব্বর ছিল। তারা সবাই মিলে এ রায় দেয়।’
এ বিষয়ে রাজৈর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ সাদী বলেন, ‘ঘটনা শোনার সাথে সাথে আমরা থানায় মামলা নিয়েছি। রাতে অভিযান চালিয়ে এ ঘটনার মূল হোতা কালু ফকিরসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। বর্বরোচিত এ ঘটনার সাথে জড়িত প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনা হবে। কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। বাকি আসামিদের ধরার ব্যাপারে জোর তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।’