তারপরও বিগত ১৬ মাসে বাংলাদেশের উপকূলে পাঁচটি তিমির মরদেহ ভেসে আসার ঘটনা ভাবিয়ে তুলেছে বিশেষজ্ঞদের। এর মধ্যে চলতি মাসেই দুদিনের ব্যবধানে দুটি তিমির মরদেহ ভেসে এসেছে কক্সবাজারের সৈকতে।
সাধারণত যে পাঁচ কারণে তিমির মৃত্যু হয় ১. স্বাভাবিক মৃত্যু। বঙ্গোপসাগর এলাকায় থাকা তিমিগুলো সাধারণত ৪০ বছরের বেশি সময় বেঁচে থাকে। ২. ফাঁস জালে জড়িয়েও অনেক তিমির মৃত্যু হয়। ৩. বড় কোনো নৌযানের সঙ্গে ধাক্কা লেগে মৃত্যু। ৪. প্লাস্টিক বর্জ্য খেয়ে মৃত্যু। ৫. রাসায়নিকের প্রভাব।
বন্য প্রাণীবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটির (ডব্লিউসিএস) বাংলাদেশের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, সর্বশেষ ওই তিমি ২টিসহ গত ১৪ বছরে বাংলাদেশের উপকূলে মোট ১০টি মৃত তিমি ভেসে এসেছে। এর মধ্যে পাঁচটির মৃতদেহ এসেছে গত ১৬ মাসে। এর সবই পাওয়া গেছে কক্সবাজারের উপকূলে। এ নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে উদ্বেগ। এর আগে ২০০৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, বরগুনা ও পটুয়াখালীর উপকূলে পাঁচটি তিমি ভেসে আসে।
২০০৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, বরগুনা ও পটুয়াখালীর উপকূলে পাঁচটি তিমি ভেসে আসে।
গবেষকেরা বলেছেন, কক্সবাজারে সর্বশেষ ভেসে আসা মৃত দুই তিমির একটি নারী, অপরটি পুরুষ। পরপর নারী ও পুরুষ দুটি তিমির রহস্যজনক এমন মৃত্যুতে আগ্রহ তৈরি হয়েছে প্রাণিবিজ্ঞানী এবং সমুদ্র গবেষকদের মধ্যে। এরই মধ্যে সরকারের পাঁচটি সংস্থা যৌথভাবে তিমি দুটির মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে কাজ শুরু করেছে। তবে প্রায় দুই সপ্তাহ হয়ে গেলেও প্রাণী দুটির মৃত্যুর কারণ জানা যায়নি।
তিমি দুটির মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে যুক্ত একাধিক গবেষক প্রথম আলোকে বলেছেন, প্রধানত পাঁচটি কারণে বেশির ভাগ তিমি মারা যায়। এই দুই তিমির মৃত্যুতে ওই পাঁচ কারণের কোনোটি কাজ করেছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে এর আগেও যেসব তিমির মরদেহ বাংলাদেশের উপকূলে ভেসে এসেছে, সেগুলোরও মৃত্যুর সুনির্দিষ্ট কারণ আজ পর্যন্ত জানা যায়নি।
বাংলাদেশের তিমিগুলো বাস করে মূলত বঙ্গোপসাগরের অতলস্পর্শ এলাকা বা সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডের উত্তর প্রান্ত ও এর আশপাশের এলাকায়। এ ছাড়া কক্সবাজারের পশ্চিমে এবং সেন্ট মার্টিন দ্বীপের দক্ষিণের গভীর সমুদ্রেও এদের দেখা পাওয়া যায়।
গবেষকেরা বলছেন, তিমির মৃত্যুর প্রধান পাঁচ কারণের অন্যতম হলো, স্বাভাবিক মৃত্যু। বঙ্গোপসাগরে যেসব তিমির বিচরণ, সেগুলো ৪০ বছরের বেশি সময় বেঁচে থাকে। এরপর তারা স্বাভাবিকভাবে মারা যায়। অবশ্য সর্বশেষ যে তিমি দুটির মরদেহ ভেসে এসেছে, সেগুলোর বয়স নিরূপণ করা যায়নি। কাজেই বলা যাচ্ছে না, এগুলো বার্ধক্যজনিত কারণে মারা গেছে কি না।
ফাঁস জালে জড়িয়েও অনেক তিমির মৃত্যু হয়। তবে ওই তিমি দুটির মরদেহ পর্যবেক্ষণ করে এমন কোনো আলামত পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন গবেষকেরা। তিমির মৃত্যুর তৃতীয় আরেকটি কারণ হলো, বড় কোনো নৌযানের সঙ্গে ধাক্কা লেগে মৃত্যু। ওই তিমি দুটির ক্ষেত্রে এমনটা হওয়ার আশঙ্কাও কম। কারণ, তাদের শরীরে এ ধরনের কোনো আঘাতের চিহ্ন দেখা যায়নি। চতুর্থত, প্লাস্টিক বর্জ্য খেয়ে মৃত্যু। তিমি বিশাল হাঁ করে তার মুখ ভর্তি করে পানি নেয়। এরপর ছাঁকনপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে পানি বের করে দিয়ে মুখে প্রবেশ করা অণুজীব ও মাছ, চিংড়িজাতীয় প্রাণী গিলে খায়। ফলে সমুদ্রে থাকা প্লাস্টিক বর্জ্য অনেক সময় তিমির পেটে চলে যায়। এগুলো পাকস্থলীতে জমে খাদ্যের হজমপ্রক্রিয়া ব্যাহত করে। এতে তিমি ধীরে ধীরে মারা যায়। প্রাথমিক ময়নাতদন্তে তিমি দুটির পাকস্থলীতে প্লাস্টিক পাওয়া যায়নি।
তিমির মৃত্যুর পঞ্চম আরেকটি উল্লেখযোগ্য কারণ হলো রাসায়নিকের প্রভাব। খাবার বা অন্য কোনোভাবে তিমির শরীরে রাসায়নিক দ্রব্য ঢুকলে বিষক্রিয়ায় এই প্রাণীর মৃত্যু ঘটে। তিমি দুটির মৃত্যুর পেছনে রাসায়নিকের প্রভাব সম্পর্কেও গবেষকেরা এখনো নিশ্চিত হতে পারেননি।
এ ছাড়া ইউরোপ ও আমেরিকায় বর্শা দিয়ে, পেনথ্রাইট গ্রেনেড মেরে ও গুলি করে তিমি হত্যার প্রচলন রয়েছে। অবশ্য বঙ্গোপসাগর এলাকায় এ ধরনের ঘটনার কোনো প্রমাণ আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
এ ব্যাপারে প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএন বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর রাকিবুল আমীন প্রথম আলোকে বলেন, হঠাৎ তিমির মৃত্যু বেড়ে যাওয়ার কারণ গুরুত্বের সঙ্গে অনুসন্ধান করা উচিত। আর বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা বেড়ে যাওয়ায় এই অঞ্চলে এখন বেশ কিছু তিমি আছে। সেগুলোকে রক্ষা করতে হলে কী করতে হবে, তার বিষদ অনুসন্ধান ও উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
গত ১৬ মাসে ভেসে আসা মৃত তিমির সবই ব্রাইডস জাতের বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ, বাংলাদেশের উপকূলে এই জাতের এ তিমিই এখন পর্যন্ত দেখা গেছে। ধারণা করা হয়, বঙ্গোপসাগরের গভীরে এ তিমির প্রজননক্ষম একটি বড় কলোনি আছে। বঙ্গোপসাগরের অতলস্পর্শ বা সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড ও এর আশপাশের এলাকাজুড়ে এরা সর্বাধিক সংখ্যায় বসবাস করে। ২০০৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সময়ে মৃত ভেসে আসা পাঁচটি তিমির মধ্যে দুটি ছিল স্প্যার্ম তিমি, দুটি ফলস কিলার বা ছদ্ম ঘাতক তিমি এবং একটি ব্রাইডস তিমি। সর্বশেষ দুটিও ব্রাইডস জাতেরই বলে মনে করা হচ্ছে।