এক সময় যাদের হাতে বেনারসি শাড়িসহ পিওর জাংলা সাটিন, জামদানি, কাতান, ধুপিয়ানসহ বিভিন্ন ডিজাইনের শাড়ি তৈরি হতো, এখন সেই হাতে তারা ভ্যান-রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। একদিকে ভারত থেকে আসা শাড়ীর দখলে বাজার অন্যদিকে করোনার প্রাদুর্ভাবে থমকে গেছে তাদের আয় রোজগারের পথ। সবকিছু নিয়ে ভালো নেই বগুড়ার শেরপুরের বেনারসি পল্লীর শাড়ি তৈরির কারিগররা। আর এখন পর্যন্ত যারা এ পেশা টিকিয়ে রেখেছেন তাদেরও দিন চলছে অতি কষ্টে। নতুন করে আর কোন কারিগর তৈরী হচ্ছে না এ পেশায়। করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে ভারত থেকে শাড়ী কম আসায় এ বছর বেনারসি পল্লীর তাঁতের তৈরি শাড়ির কিছুটা চাহিদা থাকলেও গাড়ী চলাচল না করায় ঢাকা থেকে মালামাল আনতে পারছে না। অন্যদিকে শাড়ীও দিতে পারছে না। ভারত থেকে আসা শাড়ির চেয়ে বিয়ের জন্য বেনারসি শাড়ির প্রচুর চাহিদা।
শেরপুর উপজেলার শাহবন্দেগী ইউনিয়নের ঘোলাগাড়ি কলোনি গ্রামে বেনারসি শাড়ি তৈরির কারিগরদের বসবাস। ঘোলাগাড়ি গ্রামেই আরেক পাড়ার নাম নদীয়া পাড়া। ভারতের বিহার প্রদেশ থেকে আসা এই পরিবারদেরকে স্থানীয়রা বিহারী বলে চিনে। এই পাড়ার বাসিন্দারা ভারতের নদীয়া জেলা থেকে উঠে এসে বসতি গড়ার কারণে নাম হয়েছে নদীয়া পাড়া।
এক সময় দুইপাড়ার ৭০টি পরিবারে তৈরি করা হতো বেনারসি শাড়ি। আর এ কারণেই বেনারসি পল্লী হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠে এলাকাটি। তবে বেনারসি পল্লীতে এখন আর তেমন বেনারসি শাড়ি তৈরি হয় না। হাতে গনা ১০-১২ জন এখন কাজ করে।
এ পল্লীতে এখন জামদানি, কাতান, ধুপিয়ানসহ তাঁতে তৈরি বিভিন্ন ডিজাইনের শাড়ি পাওয়া যাচ্ছে। তাও আবার সীমিত আকারে। দিন দিন চাহিদা কমে যাওয়ায় শাড়ি উৎপাদন কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক তাঁত।
এই গ্রামে প্রথম বেনারসি শাড়ি তৈরির কাজ শুরু করেন আব্দুল ওয়াহেদ। ঢাকার মিরপুরে বেনারসি পল্লীতে ১৫ বছর কাজ শিখে ১৯৯৫ সালে নিজের বাড়িতে তাঁত বসিয়ে ঘোলাগাড়ি গ্রামে প্রথম বেনারসি শাড়ি তৈরির কাজ শুরু করেন। দিন দিন শাড়ির চাহিদা বাড়তে থাকলে ঘোলাগাড়ি কলোনি ও নদীয়াপাড়ায় নারী-পুরুষ সবাই তাঁতের কাজ শুরু করেন। কয়েক বছরের ব্যবধানে দুইপাড়ায় ৭০টি তাঁত বসানো হয়। শুরু হয় বেনারসি, পিওর জাংলা সাটিন, ছাড়াও জামদানি, কাতান, ধুপিয়ানসহ বিভিন্ন ডিজাইনের শাড়ি তৈরির কাজ। আর তখন থেকেই ঘোলাগাড়ি কলোনি ও নদীয়া পাড়া বেনারসি পল্লী হিসেবে এলাকাবাসীর মুখে মুখে পরিচিত হয়ে ওঠে।
আব্দুল ওয়াহেদ জানান, বেনারসি পল্লীতে তৈরি শাড়ির চাহিদা এতটাই ছিল যে, ঢাকার বিভিন্ন শাড়ির শো-রুম থেকে আগাম টাকা দিয়ে অর্ডার দেয়া হতো। সারা বছরের পাশাপাশি রমজান মাসে চাহিদা ছিল সবচেয়ে বেশি। এ কারণে রমজান মাসে দিন রাত কাজ করত কারিগররা।
তবে গত কয়েক বছর ধরে ভারত থেকে শাড়ি আসায় তাদের কদর কমে গেছে। দাম কম হওয়ায় সেগুলো বাজারে চলে বেশি। কিন্তু বেনারসি শাড়ী বিয়ের জন্য পর্যাপ্ত চাহিদা আছে বর্তমানে পিওর জাংলা সাটিন শাড়ী তৈরী করছি যার বাজার মুল্য ৩৭ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা।
তিনি জানান, ভারতের দখলে শাড়ীর বাজার থাকার কারণে একের পর এক তাঁত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কারিগররা বেকার হয়ে পড়ায় অনেকেই ভ্যান-রিকশা চালিয়ে সংসার চালাচ্ছে।
তাঁত মালিক সালাউদ্দিন জানান, জন্ম থেকেই তাঁতের কাজ করছি। আগের মতো কাজ নেই তাদের পল্লীতে। তারপরেও ২টি তাঁত রয়েছে বাড়িতে। কোনমতে চলছে জীবন-জীবিকা। তিনি জানান, ভারতীয় শাড়িতে বাজার সয়লাব হওয়ায় ঢাকার মহাজনরাও নগদ টাকায় তাদের কাছ থেকে শাড়ি কিনতে চান না।
তাঁতি আব্দুল আজিজ জানান, কাজ না থাকায় তার তাঁত শিল্প প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। তারা বেকার বসে আছেন। গত ৫ বছরে এখানকার কমপক্ষে ৫০টি তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে।
বেনারসি শাড়ি তৈরির কারিগর মাহবুব, নাসির জানান, তাঁতে একটা শাড়ি তৈরি করতে তাদের সময় লাগে দুই থেকে তিনদিন। আবার যেগুলোতে হাতের কাজ বেশি সেই শাড়ি তৈরি করতে এক সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লেগে যায়।
বেনারসি পল্লী ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে। যে কয়েকটি তাঁত চালু আছে সেখানেই তৈরি হচ্ছে ঈদ উপলক্ষে পিওর জাংলা সাটিন, কাতান এবং জামদানি শাড়ি। এছাড়াও ৩৭ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা দামের পিওর জাংলা সাটিন শাড়ী তৈরি করা হচ্ছে বেনারসি পল্লীতে শাড়িটি তৈরী করতে সময় লাগে প্রায় ২২দিন।
এই গ্রামে প্রথম বেনারসি শাড়ি তৈরির কারিগর আব্দুল ওয়াহেদ জানান, সরকারি সুযোগ সুবিধা থাকলে যারা প্রকৃত তাঁতী তারা গ্রহণ করতে পারছেনা। ভুয়া তাঁতীদের কারণে হারাচ্ছে সরকারি সুযোগ সুবিধা। ভূয়া তাঁতী সরকারি সুযোগ নিয়ে বাড়ীঘর করছে এবং এ পেশা ছেড়ে আগের পেশায় গিয়েছে।