‘উলফ ওয়ারিয়র ডিপ্লোমেসি’ হচ্ছে প্রথাগত কূটনৈতিক পদ্ধতির বিপরীতে সি চিন পিং সরকারের অনুসৃত চীনের আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি। বিখ্যাত চীনা অ্যাকশন ফিল্ম ‘উলফ ওয়রিয়র ২’ থেকে টার্মটি নেওয়া হয়েছে। ঢাকায় সম্প্রতি এই কুটনীতির একটা প্রদর্শনী হয়ে গেল। চীনের রাষ্ট্রদূত সাফ জানিয়ে দেন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া আর ভারতের সমন্বয়ে তৈরি হওয়া জোট কোয়াডে বাংলাদেশ যোগ দিলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ‘যথেষ্ট খারাপ’ হবে। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অনেক বিশ্লেষকের কাছে এটা ছিল ‘নজিরবিহীন কাণ্ড’, কিন্তু চীনের কূটনীতির পদ্ধতি নিয়ে যাঁরা নিয়মিত খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা জানেন, এটাই ‘উলফ ওয়ারিয়র ডিপ্লোমেসি’। এই মন্তব্যের পরই প্রতিক্রিয়া জানান বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, ‘দেশের মঙ্গলের জন্য যেটা প্রয়োজন, সেটাই আমরা করব।’ তিনি আরও বলেন, ‘চীনের কাছ থেকে আমরা এ ব্যবহার আশা করিনি।’ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সার্বভৌমত্ব এবং পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারের বিষয়ে তাঁদের শ্রদ্ধাশীল থাকার কথা জানিয়ে দেন। উত্তপ্ত পরিস্থিতি সামাল দিতে চীনের পক্ষ থেকে এরপর আরও কিছু কথা বলা হয়েছে, যা এক ধরনের কুটনৈতিক বাগ্মিতার চেয়ে বেশি কিছু না। প্রশ্ন হচ্ছে, কোয়াড বা আরও বৃহত্তর পরিসরে ইন্দো প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি (আইপিএস) নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে এত চাপান-উতোর কেন?
ইলেকট্রনিকস পণ্যের সবচেয়ে বড় উৎপাদক চীন বেশ কয়েক বছর থেকেই নিজস্ব চিপ উৎপাদনের জন্য মরিয়া চেষ্টা করে যাচ্ছে। চীনের কোম্পানি সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্টারন্যাশনাল করপোরেশন (এসএমআইসি) চিপ উৎপাদক কোম্পানি হিসেবে পৃথিবীতে পঞ্চম। বিগত ট্রাম্প সরকারের সময় এই কোম্পানিটির ওপর অবরোধ আরোপের কারণে তাদের চিপ উৎপাদনের সক্ষমতা বড় বাধার মুখে পড়েছে। সবচেয়ে বড় কথা কোনো বাধা না থাকলেও সর্বোচ্চ মানের চিপ উৎপাদনের পর্যায়ে পৌঁছাতে এই কোম্পানিটির আরও বহু বছর লাগবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সর্বাধুনিক উৎপাদনের ফ্যাসিলিটি তৈরি করা ভয়ংকর ব্যয়বহুল, আর শুধু খরচ করলেই সেটা তৈরি করা যায় না, দরকার অকল্পনীয় প্রযুক্তিগত সক্ষমতা। চীনের জন্য ভীতির ব্যাপার হচ্ছে, এসএমআইসি বৈশ্বিক উৎপাদনের মাত্র ১১ শতাংশ উৎপাদন করে থাকে এবং ৫ ন্যানোমিটার কিংবা তার কম আর্কিটেকচারের মাইক্রোচিপ তৈরির আশপাশেও নেই তারা।
তাইওয়ান চীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, এটা মেনে চীনের সঙ্গে যে কারও কূটনৈতিক সম্পর্ক হওয়ার শর্ত চীনের দিক থেকে আছে। সুতরাং কাগজে-কলমে সবাই তাইওয়ানকে চীনের অংশ বলে স্বীকার করে। তাই মনে হতেই পারে, চীন যেকোনো সময় তাইওয়ান দখল (চীনের ভাষায় পুনরেকত্রীকরণ) করে নিতে পারে। সম্প্রতি চীনের প্রেসিডেন্ট তাইওয়ানের একত্রীকরণের জন্য প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগের কথাও স্পষ্ট করে বলেছেন। তার প্রমাণ দিতেই বোধ করি চীনা যুদ্ধবিমানের তাইওয়ানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করা এখন নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দক্ষিণ চীন সাগরের সংকটসহ নানা ইস্যুতে উদীয়মান শক্তি চীনের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের সংঘাতের আশঙ্কা থাকলেও স্বল্প মেয়াদে তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে যেকোনো মুহূর্তে একটা চরম সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। ঠিক এখানেই দুপক্ষের দল ভারী করে তোলার চেষ্টা, ঠিক এই কারণেই আরও বেশ কিছু দেশের মতো বাংলাদেশকে নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া।
২০২৪ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের ৭৫ বছর পূর্তি হবে। চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের বয়স বেড়ে যাচ্ছে। চীনের অর্থনীতি আগের মতো আর চাঙা নেই এবং পূর্বাভাস হচ্ছে, ভবিষ্যতে এটা আরও খারাপের দিকে যাবে। এই সবকিছুই তাইওয়ানে চীনের সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে খুব বড় অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে বলে বিশ্বের ভূরাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন থেকে বলে আসছেন। কেউ কেউ তো সেটা আগামী ৫ থেকে ৭ বছরের মধ্যে ঘটবে বলে বলেছেন।
এই পরিস্থিতির সঙ্গে পৃথিবীর চিপ-সংকটকে যদি আমরা যোগ করি, তাহলে সেই সময়টা আরও এগিয়ে আসতেই পারে। তাইওয়ান চীনের সঙ্গে একীভূত হওয়ার অর্থ হচ্ছে স্বল্প এবং মধ্য মেয়াদে চিপ উৎপাদনে চীনের প্রায় একচ্ছত্র আধিপত্য। এতে চীন যেমন নিজের চাহিদা পরিপূর্ণভাবে মেটাতে পারবে, তেমনি পণ্যটির মাধ্যমে পৃথিবীর আরও বহু ক্ষেত্রে তার প্রভাব প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। আর আরেকটি স্ট্র্যাটেজিক পণ্য ‘রেয়ার আর্থ এলিমেন্টস’-এর নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ তো তার হাতেই আছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ পৃথিবীর দুই স্ট্র্যাটেজিক পণ্যের উপর চীনের একচ্ছত্র অধিকার পশ্চিমা বিশ্ব কি মেনে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত?