১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি হায়েনা বাহিনী কর্তৃক ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যার পর ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে নেতৃত্বদানকারী দেশের বৃহত্তম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর পূর্বক্ষণে ডেভিড ব্রিউস্টারের এই মন্তব্যে আমিসহ আওয়ামী লীগের প্রতিজন কর্মী গর্বিত।
১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভুল দর্শনের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বাঙালি জাতির উপর পশ্চিম পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার, নির্যাতন, চরম অবেহলা ও দুঃশাসনে নিষ্পেষিত বাংলার জনগণের মুক্তি ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার কেএম দাস লেনে অবস্থিত রোজ গার্ডেন প্রাঙ্গণে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। পরবতীতে ১৯৫৫ সালের কাউন্সিলে অসাম্প্রদায়িক নীতি গ্রহণের মাধ্যমে নাম পরিবর্তন করে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’ নাম ধারণ করে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ শুধু এ দেশের প্রাচীন ও সর্ববৃহৎ দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলই নয়, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ইতিহাস একসূত্রে গাঁথা। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের এক দশকের স্বৈরশাসন-বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৪-এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধ, ’৬৬-এর ঐতিহাসিক ৬-দফা আন্দোলন, ’৬৮-এর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রতিরোধ আন্দোলন, ৬৯’র গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর নির্বাচনে ঐতিহাসিক বিজয়, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” খ্যাত কালজয়ী ভাষণ ও পরবর্তীতে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ৩০ লাখ শহীদের রক্ত আর ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অভ্যুদ্বয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বঙ্গবন্ধুর সরকার স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে যখন অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে এগিয়ে নিতে নিবেদিত, ঠিক তখনই স্বাধীনতাবিরোধী চক্র আন্তর্জাতিক শক্তির সহায়তায় ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে। ভাগ্যগুণে বেঁচে গেলেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা-নির্বাসনে থাকলেন বহুদিন। দীর্ঘ ৬ বছরের নির্বাসন শেষে ১৯৮১ সালের ১৭ মে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাঙালি জাতির হারানো গণতান্ত্রিক অধিকার পুনরুদ্ধারের এক নবতর সংগ্রামের পথে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পথপরিক্রমায় আজ বঙ্গবন্ধু কন্যা, রাষ্ট্রনায়ক জননেত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে ও সুদক্ষ রাষ্ট্র পরিচালনায় সুশাসন, স্থিতিশীল অর্থনীতি, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, উন্নয়নে গতিশীলতা, ডিজিটাল বাংলাদেশ, শিক্ষার প্রসার, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ, কর্মসংস্থান, বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী, খাদ্য নিরাপত্তা, নারীর ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যুগান্তকারী উন্নয়নের ফলে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশকে একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে উন্নীত হয়েছে।
স্বাধীনতার পর আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরী কিসিঞ্জার ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে ব্যঙ্গোক্তি করেছিল। রাষ্ট্রনায়ক জননেত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী ও ভিশনারী নেতৃত্বের যাদুকরি স্পর্শে সে সময়ের ব্যঙ্গোক্তিকে মিথ্যা প্রমাণ করে বাংলাদেশকে বিশ্বের উন্নয়নের ‘রোল মডেল’এ পরিণত করেছেন। খাদ্য সংকটের বাংলাদেশ, খাদ্য ভান্ডারে পরিণত হয়েছে। চলতি মৌসুমেও রেকর্ড পরিমাণ বোরো ধান উৎপাদন হয়েছে, যা গত মৌসুমের তুলনায় ১২ লাখ টন বেশি।
ডেভিড ব্রিউস্টার তার নিবন্ধে আরও লিখেছেন, ‘আজকের বাংলাদেশ ১৬ কোটি মানুষের আত্মবিশ্বাসী একটি জাতি, যাদের রয়েছে রপ্তানিনির্ভর উদীয়মান এক অর্থনীতি, যা গত দুই দশক ধরে ৬ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে।
২০২০ সালে কোভিড-১৯ এর কারণে প্রবৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ২ শতাংশে নেমে এলেও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলছে, ২০২১ সালে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৮ এবং ২০২২ সালে এটা দাঁড়াবে ৭ দশমিক ২ শতাংশে। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২২২৭ মার্কিন ডলার, যা প্রতিবেশী ভারত (১৯৪৭ ডলার) এবং পাকিস্তানের (১৫৪৩ ডলার) চেয়ে ঢের বেশি। স্বাস্থ্য, গড় আয়ু, জন্মহার এবং নারীর ক্ষমতায়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সুরক্ষা নির্দেশকগুলোর ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের চেয়ে এগিয়ে আছে‘।
ইউরোপীয় দেশগুলো যখন কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের শরণার্থীদের প্রবেশে বাধাদান করেছে, সেই সময়ে মানবতার কাণ্ডারি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৮ সালে মায়ানমারে সেনাবাহিনীর দ্বারা নির্যাতিত ও গণহত্যার শিকার হয়ে নিজভূমি থেকে বিতাড়িত ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মুসলমানদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়ে, খাদ্য ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করে আন্তর্জাতিক সমস্যায় মানবিক ও রাষ্ট্রনায়কোচিত পদক্ষেপ নিয়ে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ পরিচিত হয়েছে এক ‘মানবতাবাদী দেশ’ হিসেবে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ যে মানবিকতা ও মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছেন, তা ইতিহাসে বিরল।
বিশ্ব কূটনীতিতে এটি একটি বিস্ময়কর ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘আমার দেশের ১৬ কোটি মানুষ খেতে পারলে ১০ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমানও খেতে পারবে’। মমতাময়ী মায়ের মত নিজের আঁচলে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মুসলমানদের আশ্রয় দেওয়ার কারনেই ব্রিটিশ মিডিয়া শেখ হাসিনাকে ‘মানবতার মা (Mother of Huminity)’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক পত্রিকা খালিজ টাইমস বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ‘প্রাচ্যের নতুন তারকা’ হিসেবে অভিহিত করেছে।
২০২০ সালে মহামারী করোনা সংকটকালে ভারতের কাছে ঋণ চেয়েছিল শ্রীলঙ্কা, তাতে প্রত্যাখ্যাত হলে শ্রীলঙ্কার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তামূলক ঋণ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কাকে প্রদত্ত ঋণটি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অন্য কোনো দেশকে দেওয়া প্রথম অর্থনৈতিক সহায়তা। সুদান অর্থ ঋণ সংগ্রহে জামানত দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত নিজস্ব বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ না থাকায়, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ জামানত হিসেবে ব্যবহার করেছে।
একদা বাংলাদেশ ছিল একটি দরিদ্র সাহায্য প্রার্থী দেশ। বর্তমানে শ্রীলঙ্কাকে ২০০ মিলিয়ন ডলারের এই ঋণ প্রদান এবং ঋণ সংগ্রহে সুদানকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ জামানত হিসেবে ব্যবহার করার অনুমতি প্রদানের মাধ্যমে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অর্থনৈতিক সুস্বাস্থ্যের ইঙ্গিত করে। বর্তমানে অর্থনৈতিক উন্নয়নে সিঙ্গাপুর, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়ার মত বাংলাদেশও ‘Emerging Asian Tiger` হিসেবে খ্যাত। ভারত থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর শ্রীলঙ্কাকে অর্থনৈতিক সহায়তা করা বাংলাদেশের জন্য আঞ্চলিক প্রভাবশালী দেশ হওয়ার পথে একটি ‘টার্নিং পয়েন্ট’। শুধু শ্রীলঙ্কাকে নয়।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর শুভক্ষণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্য এই অঞ্চলে তার ভূমিকায় কেমন প্রভাব ফেলবে তা ভবিতব্যই বলে দিবে, তবে অনেক ‘আন্তর্জাতিক শক্তি’ ঢাকার দৃষ্টি আকর্ষণে লড়ে যাচ্ছেন।
আমরা গর্বিত। জয়তু শেখ হাসিনা।