‘ওসি প্রদীপ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী না দিলেও সে যে হত্যার সাথে সরাসরি জড়িত তা চার্জশিটেই প্রমাণিত হয়েছে। এখন আদালতে সাক্ষীরাই এই ঘটনা প্রমাণ করবেন। কিন্তু এত বিপুল সংখ্যক সাক্ষীদের হাজির করে সাক্ষ্য নেয়াটা সবচেয়ে কঠিন এবং দুরূহ কাজ। তা ছাড়া সাক্ষ্যগ্রহণ প্রক্রিয়া যদি আরো পিছিয়ে যায় তাহলে সব সাক্ষীকে পাওয়া যাবে কিনা এটিই আশঙ্কার বিষয়। তবুও আমাদের প্রত্যাশা সব সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ দ্রুত সময়ের মধ্যে শেষ হবে এবং এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মতো বিচার পাব।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ওসি প্রদীপ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী না দিলেও সে অপরাধের দায় থেকে নিষ্কৃতি পাবে বলে আমার মনে হয় না। প্রদীপ সিনহা হত্যার সাথে সরাসরি জড়িত। কারণ চার্জশিটে তার অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ৮০-৮৪ জন সাক্ষীকে হাজির করে সাক্ষ্য নেয়া একটি কঠিন কাজ। কারণ দীর্ঘ সময় ধরে মামলা চলতে থাকলে বিশেষ করে যদি আরো ছয় মাস বা তার চেয়েও বিলম্ব হলে অনেক সাক্ষীকে পাওয়া মুশকিল হয়ে যাবে। এত দীর্ঘ সময় ধরে সাক্ষীদের রাখাটাও একটা কঠিন কাজ এবং অনেক সময় সাক্ষীদের খুঁজে পাওয়াটাও কঠিন হয়ে যায়। সব সাক্ষীকে পাওয়া যাবে কিনা নাকি একেকজন আবার একেক জায়গায় চলে যাবে। তাদের আনা যাবে কিনা। এটাই এখন আমাদের আশঙ্কা।
ভাইকে হারানোর শোক আমরা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। বিশেষ করে আমার মা ছেলে হারিয়ে এখনো প্রায় বাকরুদ্ধ। সিনহা সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার পর মাকে প্রায়ই বলত, ‘আম্মু আজকে থেকে কিন্তু আমি শুধু তোমার সন্তান না, দেশ মাতৃকার সন্তানও। আমি যেমন তোমার সন্তান আমি দেশেরও সন্তান। তুমি সবসময় এটি মাথায় রাখবা যদি কখনো আমার কিছু হয় তুমি কখনো বিচলিত হবা না মা।’ এ কথা বলে সে আম্মুকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করেছিল। ছেলে যখন একজন মাকে এভাবে তৈরি করে তখন ছেলের কিছু হলে শোক সইবার ক্ষমতা তখন আল্লাহ দিয়ে দেন। সে প্রকৃতিকে ভীষণভাবে ভালোবাসত। চলত বিদ্যুতের গতিতে। যত দামি খাবার হোক না কেন সে পরিমাণের বাইরে একদম খেত না। ২৬ জুলাই ছিল তার জন্মদিন। প্রতি বছর এই দিন আমরা উদযাপন করতাম। গত বছর তার জন্মদিনে আমরা তার জন্য কেক পাঠিয়েছি। এবার কেটেছে বিশাল শূন্যতার মাঝে। ধুমধাম করে ঘরে ঢুকে আবার বিদ্যুৎ গতিতে চলে যেত, প্রতিটি মুহূর্তকে সে কাজে লাগাত। জীবন তো আর ওভাবে চলে না আগে যেভাবে চলত। আহাজারি আমরা সৃষ্টিকর্তার কাছে করছি। সৃষ্টিকর্তার কাছে কান্না তো দেখাতে হয়। আলটিমেটলি তার হাতেই তো চূড়ান্ত বিচার। আমার আল্লাহর কাছে ন্যায়বিচার তো পাবই।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম জানান, চলমান লকডাউনের কারণে নির্ধারিত তারিখে মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণ সম্ভব হয়নি। কোভিড পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে মামলার কার্যক্রম আবার আগের মতোই চলবে। উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাত সাড়ে ৯টার দিকে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর এপিবিএন চেকপোস্টে বাহারছড়া পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের ইনচার্জ পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলীর গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো: রাশেদ খান। হত্যাকাণ্ডের পর ৫ আগস্ট নিহত সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস বাদি হয়ে পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত ও টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপসহ ৯ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পায় র্যাব-১৫।
হত্যাকাণ্ডের পর চার মাসের বেশি সময় তদন্ত শেষে গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে এবং ৮৩ জনকে সাক্ষী করে আলোচিত মামলাটির অভিযোগপত্র দাখিল করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা রথ্যাব-১৫ এর সিনিয়র সহকারি পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম। মামলায় অভিযুক্ত ও কারাগারে আটক থাকা ১৫ আসামি হলো- বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন পরিদর্শক লিয়াকত আলী, টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, দেহরক্ষী রুবেল শর্মা, টেকনাফ থানার এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আবদুল্লাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া, কনস্টেবল সাগর দেব, এপিবিএনের এসআই মো: শাহজাহান, কনস্টেবল মো: রাজীব ও মো: আবদুল্লাহ পুলিশের মামলার সাক্ষী টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের মারিশবুনিয়া গ্রামের নুরুল আমিন, মো: নিজামুদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিন।