কার্যক্রমের শুরুতে তদন্ত কমিটি ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের মাধ্যমে কারাগারের অভ্যন্তরে তল্লাশি চালানো হয়েছে। এরপর তদন্ত সংক্রান্ত মূল কাজ শুরু করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সোমবার বেলা সাড়ে ১১টা থেকে কারাগারের অভ্যন্তরে থাকা ড্রেনগুলোতে তল্লাশি শুরু করে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিদল। দুপুর পর্যন্ত ড্রেন ও সেপটিক ট্যাংকগুলোতে হাজতি রুবেলের খোঁজ না পাওয়ার কারণে সেখানে যুক্ত হয়েছে আরও একটি সার্চ এণ্ড রেসকিউ টিম।
ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স সূত্র জানায়, কারাগারের ভেতরে থাকা ড্রেন ও সেপটিক ট্যাংকে কাজ করছে ৩ সদস্যের একটি ডুবুরি দল। অন্যদিকে রেসকিউ টিমে রয়েছে ১১ জন সদস্য। সব মিলিয়ে দু’টি দলে ফায়ার সার্ভিসের মোট ১৪ জন সদস্য কাজ করছে। কিন্তু এ রিপোর্ট লিখা পর্যন্ত নিখোঁজ হওয়া হাজতি রুবেলের সন্ধান পায়নি তারা।
এ বিষয়ে আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার কফিল উদ্দিন জানান, চট্টগ্রাম কারাগার থেকে এক হাজতি নিখোঁজের ঘটনায় অভিযান চালাচ্ছে দু’টি দল। এ দু’টি দল গঠন করা হয়েছে নন্দনকানন এবং আগ্রাবাদ ফায়ার স্টেশনের সমন্বয়ে। কারা কর্তৃপক্ষ যেভাবে চাইবে সেভাবেই সহযোগিতা করবে ফায়ার সার্ভিস।
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে হাজতি নিখোঁজের ঘটনায় পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে কারা অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসন।
কারা অধিদপ্তরের তদন্ত কমিটিতে প্রধান করা হয়েছে খুলনা বিভাগীয় উপ কারাপরিদর্শক ছগির মিয়াকে। একই কমিটিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কারাগারের জেল সুপার ইকবাল হোসেন এবং বান্দরবান জেলা কারাগারের জেলার ফোরকান ওয়াহিদকে সদস্য করা হয়েছে। আগামী ৭ কর্মদিবসের মধ্যে তাদের তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
এ ঘটনায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। কমিটিতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সুমনি আক্তারকে আহ্বায়ক এবং এডিসি (ট্রাফিক-উত্তর) মোহাম্মদ রাশেদুল ইসলাম এবং চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের ডেপুটি জেলার মো. মাজহারুল ইসলামকে সদস্য করা হয়। কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
এদিকে কারা কর্তৃপক্ষের গঠিত কমিটি সোমবার (৮ মার্চ) সকাল থেকে কাজ শুরু করেছে। কমিটির প্রধান খুলনা বিভাগের কারা উপ মহাপরিদর্শক (ডিআইজি-প্রিজন) ছগির মিয়াসহ তিন সদস্য চট্টগ্রাম বিভাগের কারা উপ মহাপরিদর্শক এ কে এম ফজলুল হকের সঙ্গে বৈঠক করেন। এরপর তারা চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকের সঙ্গেও কথা বলেন।
তিনি বলেন, বিশাল কারাগার, অনেক সেফটি ট্যাংক, অনেক বড় বড় নালা-নর্দমা। হাজতি কোথাও মরে পড়েও তো থাকতে পারে। এখন আমার তো এত লজিস্টিক সাপোর্ট নাই যে কারাগারের ভেতরে তল্লাশি করতে পারবো। সেজন্য ফায়ার সার্ভিস কল করেছিলাম। কারাগারের সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজার পরও নিখোঁজ হাজতিকে পাওয়া যায়নি। তাই ওইদিনের সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করে তা যাচাই করা হচ্ছে।
এদিকে ঘটনাস্থল সরেজমিন দেখতে গতকাল রোববার বিকেল ৪টার দিকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার পরিদর্শনে যান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. শহিদুজ্জামান। এ সময় তাকে অভ্যর্থনা জানান চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার শফিকুল ইসলাম খান।
প্রসঙ্গত, শনিবার (৬ মার্চ) সকালে কারাগার থেকে নিখোঁজ হওয়া হাজতি রুবেলের হদিস পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করে রুবেল কী পালিয়ে গেল, নাকি তাকে ঘিরে কারা অভ্যন্তরে অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা ঘটেছে, তা নিশ্চিত করে কেউ কিছু বলতে পারছেন না। উদ্ভূত এ পরিস্থিতির মধ্যে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
এদিকে কারাগার থেকে হাজতি রুবেল নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগে জেলার মো. রফিকুল ইসলামসহ এক ডেপুটি জেলারকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এছাড়া কর্ণফুলী ভবনের ১৫ নম্বর সেলের দায়িত্বরত কারারক্ষী নাজিম উদ্দিন ও সহকারী কারারক্ষী ইউনুস মিয়া সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন। সহকারী প্রধান কারারক্ষী কামাল হায়দারের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে।
কারা সূত্র জানা যায়, নিখোঁজের দুইদিন আগে ৪ মার্চ অন্য বন্দির সাথে মারামারিতে লিপ্ত হয় রুবেল। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে রুবেলকে শাস্তি হিসাবে কর্ণফুলী ভবনের ১৫ নম্বর ‘পানিশমেন্ট’ ওয়ার্ড’-এ ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে রাখা হয়েছিল।
এদিকে শনিবার (৬ মার্চ) ভোর থেকে হাজতি রুবেলের সন্ধান না মেলায় দিনভর তল্লাশি করে সন্ধ্যায় জিডির পর রাতে মামলা করেন প্রত্যাহার হওয়া জেলার রফিকুল ইসলাম। কোতোয়ালী থানার মামলা নম্বর ২৩/২১। ধারা-দণ্ডবিধির ২২৪।
মামলার এজহারে তিনি উল্লেখ করেন, শনিবার (৬ মার্চ) ভোর ৬টা থেকে তালামুক্ত করার পর ফরহাদ হোসেন ওরফে রুবেল নামে এক হাজতিকে পাওয়া যাচ্ছে না। যার হাজতি নম্বর ২৫৪৭/২১। তিনি গত ৯ ফেব্রুয়ারি সদরঘাট থানার একটি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আসেন। তার গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানায়। আগের দিন শুক্রবার রাতে সবার সাথে রুবেলও কারাগারের কর্ণফুলী ভবনের ৫ম তলার ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে থাকলেও ভোর সাড়ে ৬টার পর থেকে তার হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। পরে দায়িত্বরত কারারক্ষী ও হাজতিদের কাছ থেকে জানতে পারেন, হাজতি রুবেল শনিবার ভোর ৫টা ১৫ মিনিটে ওয়ার্ড থেকে বের হয়ে যান। পরবর্তীতে পুরো কারাগারে তল্লাশি করেও তার হদিস মেলেনি।
এর আগে শনিবার দিনভর কারা অভ্যন্তরে তল্লাশি করেও হদিস না পেয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছে কারা কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মো. শফিকুল ইসলাম খান কোতোয়ালী থানায় জিডি করেন। জিডি নম্বর-৪১৭।
জিডিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সদরঘাট থানায় দায়ের হওয়া একটি মামলায় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের অর্ন্তবর্তীকালীন হাজতের পরোয়ানা মোতাবেক গত ৯ ফেব্রুয়ারি রুবেলকে কারাগারে পাঠানো হয়। শনিবার সকাল ৬টা থেকে কারা অভ্যন্তরে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। তার সন্ধানে কারা অভ্যন্তরে তল্লাশি চলছে।
জানা যায়, এর আগে ২০১৮ সালে নরসিংদীর রায়পুরার ফরহাদ হোসেন রুবেল কারাগারে গেলে সেই সময় দুইবার কারাগারের ড্রেনে ও ছাদে আত্মগোপন করেন। সেই সময় ব্যাপক খোঁজাখুঁজির পর দুইবারই তাকে উদ্ধার করে কারা কর্তৃপক্ষ। এবারও তিনি সেই কাজ করেছেন ধারণা করে কারা কর্মকর্তারা আশা করছেন, রাতের মধ্যেই কারাগারের ভেতর থেকে তার সন্ধান মিলবে।
রুবেল সদরঘাট থানার এসআরবি রেল গেইট এলাকায় ৫ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে তুচ্ছ ঘটনায় আবুল কালাম আবু নামের এক ভাঙারি ব্যবসায়ীকে বুকে ছুরিকাঘাত করেন। পরদিন সকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কালাম হাসপাতালে মারা যান। ৬ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে হত্যার অভিযোগে ডবলমুরিং থানার মিস্ত্রি পাড়া থেকে ফরহাদ হোসেন রুবেলকে গ্রেপ্তার করে সদরঘাট থানা পুলিশ। ওই মামলায় ৯ ফেব্রুয়ারি আদালতের মাধ্যমে কারাগারে যান রুবেল।